গ্রাফিক্স ডিজাইনে পড়াশোনা করা রবিন, প্রথম ২০০৭ সালে জাল টাকা তৈরির চেষ্টা করেন। লালবাগের শহীদ নামে এক বন্ধুর সহযোগিতায় চেষ্টা করলেও তখন ব্যর্থ হন রবিন। এরপর তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যে মন দেন। এরপর পুরান ঢাকার ইসলামপুরে প্লাস্টিক দানার কারখানাসহ কাপড়ের ব্যবসায় নামেন তিনি। করোনাকালে তার ব্যবসায় বন্ধ হয়ে যায়। কর্মচারীরা বেতনের জন্য বাসায় ভিড় করেন। ব্যবসা সামলানো ও কর্মচারীদের বেতন দিতে জাল টাকা ও রুপির কারবারে জড়িয়ে পড়েন রবিন।
জাল টাকা বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত হুমায়ুন ও শফিউল্লাহ নামে দুজনের সঙ্গে পরিচয় ও যোগাযোগ হয় রবিনের। জাল টাকার চেয়ে জাল রুপিতে আগ্রহী চক্রটির সহযোগিতায় জাল টাকা ও রুপি তৈরি শুরু করেন তিনি। সেই সময় থেকেই জাল টাকার কারবার পরিচালনা করে আসছিলেন রবিন। জাল টাকায় মাদক চোরাচালানে এবং জাল রুপি সীমান্ত থেকে অবৈধভাবে বিভিন্ন পণ্য চোরাচালানের মূল্য পরিশোধ করে আসছিল চক্রটি। রবিন এ জাল টাকার কারবারে জড়ান নিজের ভাই ও ভাগ্নেকেও।
চক্রটির দুই ভাই ও ভাগ্নে চক্রকে ভারতীয় জাল ১ লাখ রুপি, ১০ লাখ ২০ হাজার জাল টাকা এবং জাল রুপি-টাকা তৈরির সরঞ্জামাদিসহ গ্রেপ্তারের পর এমন তথ্য দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
গতকাল বেলা ১২টায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. জাফর হোসেন।
তিনি বলেন- গত শুক্রবার লালবাগ থানাধীন আরএনডি রোডের শ্মশানঘাট কালীমন্দিরের সামনে থেকে প্রথমে চক্রের সদস্য ভাগ্নে মো. মাহিকে (১৯) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চক্রের মূল হোতা সাজ্জাদ হোসেন রবিন (৩৮) ও রবিনের ছোট ভাই সাদমান হোসেন হৃদয়কে (৩০) গ্রেপ্তার করে ডিএমপির লালবাগ থানা পুলিশ।
তিনি বলেন, গত শুক্রবার সন্ধ্যায় লালবাগ শ্মশানঘাট কালীমন্দিরের সামনে থেকে মো. মাহিকে বাংলাদেশি ১ হাজার টাকার ৫০টি জাল নোটের ৫০ হাজার টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মাহির মামা সাজ্জাদ হোসেন রবিন ও সাদমান হোসেন হৃদয়কে কেরানীগঞ্জের কানারগাঁওয়ের একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের হেফাজত থেকে বাংলাদেশি ১ হাজার টাকার ৯ লাখ ৭০ হাজার টাকার ৯৭০টি জাল নোট এবং ভারতীয় ৫০০ রুপি মূল্যমানের ১ লাখ রুপির ২০০টি জাল রুপিসহ জাল টাকা ও জাল রুপি তৈরির ল্যাপটপ, প্রিন্টার, একটি স্ক্রিন প্রিন্ট ফ্রেম, জালনোট তৈরির জন্য ২০০ পিচ সাদা কাগজ, বিভিন্ন রংয়ের চারটি কার্টিজ, কোটাসহ বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়।
ডিসি আরো বলেন, গ্রেপ্তার সাজ্জাদ হোসেন রবিন পেশায় গ্রাফিক্স ডিজাইনার। ২০০৭ সালে জাল টাকা তৈরিতে ব্যর্থ রবিন করোনাকালে ব্যবসায় ধস নামায় জাল টাকার কারবারে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় পলাতক আসামি হুমায়ুন কবির সিকদার (৪২) ও মো. শফিউল্লাহ্ সিকদার রবিনকে সার্বিক সহযোগিতা করে। হুমায়ুন ও শফিউল্লাহ ২০০৭ সাল থেকেই জাল টাকা তৈরির কারবারে জড়িত। জাল টাকা ও জাল রুপি তৈরিতে রবিনকে সহযোগিতা করে সাদমান হোসেন হৃদয়।
ডিসি জাফর হোসেন বলেন, রবিন জাল টাকার চেয়ে রুপিই বেশি তৈরি করতেন। এখন পর্যন্ত রবিন জাল টাকা ছাড়াও প্রায় ৫ কোটি রুপি তৈরি করে চক্রকে সরবরাহ করেছে। সীমান্তে চোরাচালানে রুপি ও টেকনাফ সীমান্তে ইয়াবার চালান আনার ক্ষেত্রে রুপির অর্ডার দিতেন হুমায়ুন ও শফিউল্লাহ। সর্বশেষ টেকনাফ থেকে ইয়াবার চালান আনার জন্য জাল টাকা তৈরির অর্ডার দেয় তারা। সেটিই তৈরি করেছিলেন রবিন। তবে সরবরাহের আগেই ধরা পড়ে যান তিনি।
উপ-পুলিশ কমিশনার মো. জাফর হোসেন বলেন, ১ লাখ রুপি ২৭ হাজারে এবং ১ লাখ টাকা মাত্র ১০ হাজারে চক্রকে সরবরাহ করতেন রবিন। তৈরি করা জাল টাকায় নিজের কারখানার শ্রমিকদের বেতনও দিতেন রবিন। রবিন এর আগে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। হুমায়ুনও ২০২০ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। রবিন হৃদয় হচ্ছেন সহোদর, মাহি সম্পর্কে ভাগ্নে। জাল টাকার মূল কারবারি হুমায়ুন ও শফিউল্লাহসহ চক্রের পলাতক সদস্যদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে।
জাল মুদ্রার তৈরি সম্পর্কে ডিসি জাফর বলেন, চক্রটি দুইভাবে কাজ করে। মাল্টিপ্ল্যান মার্কেট থেকে তারা প্রিন্টার, কালি ও থ্রেড পেপারস সংগ্রহ করে। এরপর তারা সফটওয়ারে ফেলে কালার প্রিন্ট করে। আসল ১ হাজার টাকার নোটে ৫ মিলি নিরাপত্তা সুতা থাকে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হলোগ্রাম থাকে। তাছাড়া আসল টাকা হাতে নিলেই বোঝা যায়। আমাদের আসলে সচেতন হওয়া উচিত। জাল টাকার কারবারে বন্ধে আসল টাকা চেনাও ভোক্তা বা এর ব্যবহারকারীর সতর্কতাও জরুরি।