অনিশ্চয়তার পথে ইমরান খানের রাজনৈতিক জীবন

প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

তিন বছরের কারাদণ্ডের রায় নিয়ে বন্দি জীবন শুরু করেছেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। শাস্তির মেয়াদ শুরু হওয়ায় পাকিস্তানের পরবর্তী সময়ে পার্লামেন্ট নির্বাচনে তার অংশগ্রহণ অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। চলতি বছরের নভেম্বর মাসে দেশটিতে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও সেটি সময়মতো হচ্ছে না। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, ইমরান খানকে কারাদণ্ডাদেশ দেশটির অভ্যন্তরীণ সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অন্য কোনো প্রভাবশালী দেশ ইমরান খানের কারাবন্দি জীবন নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তান সরকারের ওপর বিদেশি কোনো সরকারের কোনো চাপ নেই। আগামী সাধারণ নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হওযার যোগ্যতা হারিয়েছেন। জামিন না হলে তাকে কারাগারেই থাকতে হবে। আর নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ায় এক অনিশ্চিত রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করলেন ইমরান খান। পাকিস্তানের বহুল আলোচিত তোশাখানা দুর্নীতি মামলায় ইমরান খানকে আদালত ৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পরপরই গ্রেপ্তার করা হয়। গত শনিবার ইসলামাবাদের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালতের বিচারক রায় ঘোষণার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই সঙ্গে আগামী ৫ বছরের জন্য ইমরান খানকে দেশটির সক্রিয় রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করেছে আদালত। সাবেক ক্রিকেট তারকা থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ৭০ বছর বয়সি ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের উপহার সামগ্রী কেনাকাটায় দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছিল। বিদেশ সফরের সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে পাওয়া এসব উপহার সামগ্রীর মূল্য ১৪০ মিলিয়ন পাকিস্তানি রুপির বেশি। তোশাখানা বিতর্কের শুরু হয় ২০২১ সালে। ওই সময় দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তার স্ত্রী বুশরা বিবি রাষ্ট্রীয় তোশাখানা থেকে বিদেশিদের দেওয়া বিভিন্ন উপহার নামমাত্র মূল্যে কিনে নেন। পরে সেসব উপহার উচ্চ দামে করে দেন তারা। গত বছরের ২১ অক্টোবর পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি) সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় কোষাগারের উপহার সামগ্রী সম্পর্কে ‘মিথ্যা বিবৃতি ও ভুল ঘোষণা’ দিয়েছিলেন বলে জানায়। একই সঙ্গে দেশটির সংবিধানের ৬৩(১)(পি) অনুচ্ছেদের অধীনে তাকে নির্বাচনে ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করে। পরবর্তীতে দেশটির নির্বাচনি এই পর্যবেক্ষক সংস্থা রাজধানী ইসলামাবাদের একটি দায়রা আদালতে ইমরান খানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। ওই সময় পিটিআই প্রধানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার আবেদনে ক্ষমতায় থাকাকালীন বিদেশি বিশিষ্টজনদের কাছ থেকে প্রাপ্ত উপহার সম্পর্কে ইমরান খান ইসিপিকে ‘ভুল’ তথ্য দিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়। এরপর ট্রায়াল কোর্ট গত ১০ মে পিটিআই চেয়ারম্যানকে অভিযুক্ত করে এবং মামলাটির গ্রহণযোগ্যতা বাতিল চেয়ে ইমরান খানের করা আবেদন খারিজ করে দেয়। ইসলামাবাদের হাইকোর্ট গত ৪ জুলাই ট্রায়াল কোর্টের রায় বাতিল এবং আবেদনকারীকে পুনরায় শুনানিতে অংশগ্রহণ ও ৭ দিনের মধ্যে এ মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশ দেয়। ৮ জুলাই দায়রা আদালতের অতিরিক্ত বিচারক হুমায়ুন দিলাওয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে তোশাখানা মামলার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। পরে ইমরান খানের আইনজীবীরা এ মামলার কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আবারও ইসলামাবাদ হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করেন। বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন ইমরান খানের আইনজীবীরা তার ফেসবুক পোস্টের ভিত্তিতে আদালতের বিচারকের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও এনেছিলেন এবং মামলাটি অন্য আদালতে স্থানান্তর চেয়েছিলেন। ২ আগস্ট ট্রায়াল কোর্ট পিটিআই চেয়ারম্যানের জমা দেওয়া মামলার সাক্ষীদের তালিকা খারিজ করে জানায়, ইমরান খান তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যক্রমে সাক্ষীদের ‘প্রাসঙ্গিকতা’ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। পরে ইমরানের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে ট্রায়াল কোর্টের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতেও চ্যালেঞ্জ করা হয়। পরবর্তী সময়ে পিটিআই চেয়ারম্যান আবার হাইকোর্টে স্থগিতাদেশ চেয়ে মামলাটি অন্য আদালতে স্থানান্তরের আবেদন করেন। গত ৪ আগস্ট ইসলামাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আমির ফারুক নির্বাচন কমিশনের অভিযোগ দাখিলের এখতিয়ার ও এতে পদ্ধতিগত কোনো ত্রুটি হয়েছে কি-না তা পুনঃপরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়ে বিষয়টিকে ট্রায়াল কোর্টে ফেরত পাঠান। গত শনিবার বিচারক হুমায়ুন দিলাওয়ার যখন এই মামলার শুনানি পুনরায় শুরু করেন, তখন পিটিআই চেয়ারম্যানের কোনো প্রতিনিধি তার সামনে উপস্থিত ছিলেন না। এরপর আদালত একাধিকবার শুনানি মুলতবি করে এবং ইমরানের আইনজীবী দলের কেউ হাজির না হওয়ায় রায় সংরক্ষণ করেন। পরে বিচারক রায় ঘোষণা করে বলেন, পিটিআই প্রধানকে দুর্নীতির জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং তাকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ইমরান খান তোশাখানা মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি কয়েকবার এড়িয়ে গেছেন। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী সম্পদের ঘোষণায় তোশাখানা থেকে যেসব উপহার সরিয়ে নিয়েছিলেন, তার বিবরণ গোপন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গত শতকের সত্তরের দশকে পাকিস্তানের সরকারি একটি বিভাগ হিসেবে তোশাখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই বিভাগটি প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, আইনপ্রণেতা, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান ও অন্যান্য বিশিষ্টজনদের দেওয়া উপহার জমা রাখে। তোশাখানার নিয়ম অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী, আইনপ্রণেতা বা সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের পাওয়া সব উপহার অবশ্যই এই বিভাগে জমা দিতে হবে। যারা এসব উপহার পেয়েছেন তারা পরে এগুলো কিনে নিতে পারবেন।

এদিকে পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খানকে গ্রেপ্তার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও স্বাধীন পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, এ ঘটনা দক্ষিণ এশীয় দেশটির রাজনৈতিক সংকট আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম ডনকে বলেছেন, ইমরান খান এবং অন্যান্য রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে মামলা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমরা সারা বিশ্বের মতো পাকিস্তানেও গণতান্ত্রিক নীতি ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানাই।

যুক্তরাষ্ট্রের যেসব আইনপ্রণেতা এর আগে ইমরান খানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন, তারা এখন পর্যন্ত নীরব রয়েছেন। তবে মুখ খুলেছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক স্কলার মাইকেল কুগেলম্যান টুইট করেছেন, কিছুদিন আগে পাকিস্তান সরকার পদত্যাগ করার এবং নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে দেশটির রাজনৈতিক সংকট কিছুটা কমেছে বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখন, ইমরান খানকে আবার গ্রেপ্তার করায় এবং নির্বাচন বিলম্বিত হতে যাচ্ছে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে হচ্ছে না পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন। দেশটির আইনমন্ত্রী আজম নাজির তারার এ তথ্য জানিয়েছেন।

আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম জিও নিউজকে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ভোটার তালিকা এখনও হালনাগাদ হয়নি। আদমশুমারির মাধ্যমে এটি (হালনাগাদ) করতে হবে। শুমারি শেষে নতুন ভোটার তালিকা তৈরিতে অন্তত ৪ থেকে ৫ মাস সময় লাগবে।’ ‘এ ছাড়া কোনো সাংবিধানিক আসনের আয়তন কতখানি হবে, সেটিও নির্ভর করছে নতুন ভোটার তালিকার ওপর। তালিকা আসলে আসনগুলোর আয়তন পুনর্বিন্যাস করতে হবে। সেখানেও অন্তত দেড় থেকে দু’মাস সময় দরকার।’ আজম নাজির তারার বলেন, গত শনিবার পাকিস্তানের বিশেষ সরকারি সংস্থা কাউন্সিল অব কমন ইন্টারেস্টের (সিসিআই) বৈঠকে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ। সিসিআই মূলত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকারগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করে। জাতীয় যেকোনো ইস্যুতে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের ঐক্যমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্ল্যাটফরম হিসেবে কাজ করে সংস্থাটি। গত শনিবারের বৈঠকে কেন্দ্রীয় ও পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে নাজির তারার বলেন, ‘সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে আগামী নির্বাচন হবে নতুন ভোটার তালিকার ভিত্তিতে।’ ‘এখন, সব দিক সামাল দিয়ে কবে নির্বাচনের আয়োজন করা সম্ভব হবে, সেই ঘোষণা দেবে নির্বাচন কমিশন।’