ঢাকা ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চকরিয়া-পেকুয়ায় বন্যা ট্র্যাজেডি

একই কবরস্থানে শায়িত হলো বাবাসহ তিনজন

চার শিশুসহ ছয়জনের মরদেহ উদ্ধার
একই কবরস্থানে শায়িত হলো বাবাসহ তিনজন

কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে চার শিশুসহ আটজন মারা গেছেন। এর মধ্যে চকরিয়ায় নিজ বাড়ির সেফটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে নেমে বিষাক্ত গ্যাসে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে বাবা-ছেলেসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের গতকাল বাদ আছর একই কবরস্থানে শায়িত করা হয়েছে। অন্যদিকে বন্যা-পরবর্তী সময়ে পেকুয়া-চকরিয়ায় চার শিশুসহ আরো ছয়জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

গতকাল সকাল থেকে দুপর পর্যন্ত পেকুয়া ও চকরিয়ায় চার শিশুসহ পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে পেকুয়া উপজেলায় তিনজন এবং চকরিয়া উপজেলায় অজ্ঞাতনামা একজনসহ দুইজনের মরদেহ পাওয়া যায়। মৃতরা হলো চকরিয়া উপজেলার বদরখালী ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ভেরুয়াখালীপাড়ার মো. এমরানের ছেলে মো. জিশান (৯) এবং পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নের নুরুল আলমের মেয়ে তাহিদা বেগম (১০) ও ছেলে আমির হোছাইন (৭) ও তাদের নিকটাত্মীয় ছাবের আহমদের মেয়ে হুমাইরা বেগম (৮)। এছাড়া অজ্ঞাতনামা অপরজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের মহেশখালী খাল লাগোয়া এলাকা থেকে।

আমাদের চকরিয়া প্রতিনিধি একেএম ইকবাল ফারুক ও পেকুয়া প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান অপুু জানান, গতকাল সকাল ১১টার দিকে পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নের ফেরাসিঙ্গাপাড়ার সাহেবখালী খাল থেকে তিন শিশুর মরদেহ উদ্ধারের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পূর্বিতা চাকমা। উজানটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান তোফাজ্জল করিম জানান, গত বুধবার বিকালে তিন শিশু পাশের সাহেবখালী খালের পাশে ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে যায়। সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফেরার পথে সাহেবখালী খালে পড়ে নিখোঁজ হয়। গতকাল সকাল ৭টার দিকে ওই খালে তাদের মরদেহ ভেসে ওঠে। তিন শিশুর মরদেহ উদ্ধার করে দাফনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

গতকাল সকাল ১০টায় বদরখালী ইউনিয়নের ভেরুয়াখালী নতুন বাজারের পাশে মো. জিশান নামের এক শিশুর এবং দুপুর ১২টার দিকে চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের মহেশখালী খাল লাগোয়া এলাকা থেকে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করা হয় বলে জানিয়েছেন চকরিয়া থানার ওসি মো. জাবেদ মাহমুদ।

তিনি জানান, বদরখালীতে গত বুধবার সকালে বন্যার পানিতে খেলা করছিল মো. জিশান। এ সময় সে বন্যার পানির স্রোতে ভেসে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর গতকাল সকালে ভেরুয়াখালী নতুন বাজার এলাকা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয় লোকজন।

এছাড়া গতকাল দুপুর ১২টায় চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের মহেশখালী খাল-লাগোয়া এলাকা থেকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান চকরিয়া থানার ওসি।

জাবেদ মাহমুদ জানান, স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল মরদেহটি উদ্ধার করে। মৃতদেহ অর্ধগলিত হয়ে বিকৃত হয়ে যাওয়ায় পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

মৃতদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানান ওসি।

এদিকে, চকরিয়ায় সেফটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে নেমে বিষক্রিয়ায় দুই ছেলের মৃত্যু ঘণ্টা চারেক পর চলে গেলেন তাদের বাবাও। গত বুধবার রাত ৩টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আনোয়ার হোসেন মারা যান।

এর আগে একই ঘটনায় গত বুধবার রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় আনোয়ারের দুই ছেলে শহিদুল ও শাহাদাতকে চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। চকরিয়া থানার ওসি জাবেদ মাহমুদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

দুই ভাই ও বাবার মৃত্যুর বিষয়টি আনোয়ারের মেজ ছেলে মৌলভি মঞ্জুর আলমও নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, কয়েক দিন ধরে ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢলে চকরিয়া উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে উপজেলার বিএমচর ইউনিয়নের বহাদ্দরকাটায় তাদের বসতভিটাও তলিয়ে যায়। বসতভিটা থেকে পানি নেমে যাওয়ায় রাত ১০টার দিকে আনোয়ারের দুই ছেলে শহিদুল ও শাহাদাত সেফটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে নামেন। একপর্যায়ে তাদের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তাদের বাবা আনোয়ার হোসেন ট্যাংকে নামেন। একসময় তারও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে লোকজন তাদের উদ্ধার করে অচেতন অবস্থায় চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসক দুই ভাই শহিদুল ও শাহাদাতকে মৃত ঘোষণা করেন। আর আশঙ্কাজনক অবস্থায় বাবা আনোয়ারকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসক। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গভীর রাতে গভীর ঘুমে চলে গেলেন তিনিও।

চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক শোভন দত্ত বলেন, ‘বধুবার রাতে ওই দুই ভাই হাসপাতালে আনার আগেই মারা যান। তাদের অক্সিজেনের ঘাটতি ও মিথেন গ্যাসের বিষক্রিয়া ছিল। এতে আঙ্ককাজনক অবস্থায় একজনকে (আনোয়ার হোসেন) চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠানো হয়েছিল।’

বিষক্রিয়ার বিষয়টি ব্যাখা করে তিনি বলেন, ‘মাটিতে গর্ত করে তৈরি করা ট্যাংকে অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডসহ সালফারের অন্যান্য গ্যাস, মিথেন, এমনকি বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড তৈরি হতে পারে। বদ্ধ থাকার ফলে এসব গ্যাস ক্রমশ ঘন হতে থাকে এবং সেই সঙ্গে অক্সিজেনের স্বল্পতা তৈরি হতে থাকে। কখনো কখনো এ ধরনের বদ্ধ কূপ একেবারে অক্সিজেন শূন্য য়ে যায়। এই কারণে সতর্কতা গ্রহণ ব্যতীত সেপটিক ট্যাংকের গভীরে নামলে অক্সিজেনের অভাবে ও পাশাপাশি মিথেন গ্যাসের বিষক্রিয়ায় মানুষ জ্ঞান হারানোর সম্ভাবনা থাকে। দ্রুত সময় সজ্ঞানে বের হয়ে আসতে না পারলেই বিপর্যয় ঘটে। অক্সিজেন ঘাটতির কারণে মস্তিষ্কে হাইপোক্সিয়া ও কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়ে ব্যক্তি মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

চকরিয়া থানা ওসি জাবেদ মাহমুদ বলেন, তাদের মৃত্যুর ঘটনা জানতে পেরেই ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ না থাকায় মরদেহের সুরতহাল তৈরি পূর্বক পরিবারের আবেদনের আলোকে কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে গতকাল সকালে মরদেহ দাফনের জন্য তাদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে নিজস্ব এলাকার কবর স্থানে তিনজনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত