ঢাকা ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চট্টগ্রামে হদিস নেই হাজারো পুকুরের

* নগরীতে কমছে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর। * হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক জলাধার।
চট্টগ্রামে হদিস নেই হাজারো পুকুরের

চট্টগ্রামে কয়েক হাজার পুকুরের কোনো হদিস নেই। চলছে পুকুর ভরাটের মহোউৎসব। অভিযোগ রয়েছে, পুকুর ভরাটে কোনো নিয়মণ্ডনীতি নেই। তাই কোনো ধরনের নিয়মণ্ডনীতির তোয়াক্কা না করে এসব পুকুর ভরাট হচ্ছে। নগরী থেকে ছোট ও বড় পুকুর হারিয়ে গেছে বহু আগেই। এভাবে পুকুর উধাও হওয়ায় উদ্বিগ্ন নগরবাসী। প্রাকৃতিক এসব জলাধার এভাবে বিলীন হয়ে যাওয়ায় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেদারসে পুকুর ভরাট বা পুকুর দখল করায় ফায়ার সার্ভিস জরুরি মুহূর্তে পানি সংকটে পড়েছে। আবার ভারি বর্ষণে পানি ধরে রাখার প্রাকৃতিক ব্যবস্থাও কমে গেছে। এতে বর্ষণের সময় দেখা দেয় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা।

সরেজমিন কয়েকটি স্থান পরিদর্শন করে দেখা যায়, বেশিরভাগ পুকুর বা জলাশয় দখল করে অবৈধভাবে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। অনেক পুকুর ভরাট করে আবাসনের কাজ চলছে। গত ১৬ বছরেই নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে হারিয়ে গেছে কয়েক হাজার পুকুর। জলাধার সংরক্ষণ আইনের কোন তোয়াক্কা করছে না দখলবাজরা। ভরাটের পর নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবন, মার্কেট। এতে নগরীতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। একদিকে যেমন জলাবদ্ধতা প্রকট হচ্ছে। অন্যদিকে বাড়ছে নগরীর উষ্ণতা। জলজ উদ্ভিদের উৎস নষ্ট হওয়ায় জীব বৈচিত্র হুঁমকির মুখে পড়েছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ২০০৬-০৭ সালের মাস্টারপ্ল্যান প্রতিবেদন অনুযায়ী সেই সময় নগরীতে হাজারো পুকরের খোঁজ মেলে। ওই সময়ের পর সিডিএ পুকুর নিয়ে আর কোনো জরিপ চালায়নি। তবে মৎস্য অধিদপ্তর এবং ফায়ার সার্ভিস আলাদা করে জরিপ করেছে। মৎস্য অধিদপ্তরের হালনাগাদ করা তথ্য অনুযায়ী নগরীতে এখন পুকুরের সংখ্যা মাত্র ৫৯০টি। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিসের হালনাগাদ করা তথ্য অনুযায়ী নগরীতে এখন পুকুরের সংখ্যা মাত্র ২৭৩টি। দুই ধরনের পুকুরের তালিকা নিয়ে দেখা দিয়েছে ধূম্রজাল।

এ ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, যেসব পুকুর এখনো টিকে আছে জরিপে সেসব পুকুর চিহ্নিত করা হয়েছে। তাছাড়া অগ্নিকাণ্ডের সময় যেসব পুকুরের পানি ব্যবহার করা যাবে, সেসব পুকুরের ওপর জরিপ চালিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। তবে এর বাইরেও উপকূলীয় এলাকায় বেশ কিছু পুকুর রয়েছে। যেখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাছ চাষ করা হয়। সেসব পুকুর আমাদের জরিপে আসেনি। কারণ ওইসব এলাকায় মানুষের বসবাস তেমন গড়ে উঠেনি।

চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, নগরীতে পুকুরের সংখ্যা কমে আসছে ধীরে। সম্প্রতি পুকুর নিয়ে একটি জরিপ চালানো হয়। মৎস্য অফিসের সীমিত জনবল নিয়ে জরিপটি পরিচালনা করা হয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের জরিপে হালিশহর, পাহাড়তলী, উত্তর হালিশহর, কাট্টলী, ফতেয়াবাদ এলাকার পুকুরের তথ্য উঠে এসেছে বেশি। আমাদের জরিপে সাধারণ পুকুরের পাশাপাশি যেসব পুকুরে মাছ চাষ করা হয়েছে তার পরিসংখ্যানও উঠে এসেছে।

এদিকে নগরীতে পুকুর কমে যাওয়ায় নানা ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এখনই দেখা যাচ্ছে। পুকুর কমে যাওয়ায় কমছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। ২০১১ সালে নগরীর আগ্রাবাদে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ২৪১ ফুট নিচে। ওই সময়ে পাহাড়তলীতে ১৩৬ ফুট, খুলশীতে ২২০ ফুট ও বায়েজিদে ১৫৫ ফুট নিচে পানির স্তর পাওয়া যায়। তবে মাত্র একযুগের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ নেমে গেছে পানির স্তর। চলতি বছর আগ্রাবাদে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পাওয়া গেছে ৩০২ ফুট নিচে। এছাড়া পাহাড়তলীতে ২৬০ ফুট, খুলশীতে ৪৪০ ফুট ও বায়েজিদে ২৮০ ফুট নিচে পানির স্তর পাওয়া গেছে। নগরীতে নতুন নতুন ভবনের সঙ্গে গভীর নলকূপের সংখ্যা বাড়ায় এবং পুকুরের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এর ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদেরা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র একজন কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম নগরীর পুকুরগুলো একে একে ভরাট করে ফেলার কারণে বর্ষায় জলাবদ্ধতা প্রকট হচ্ছে। পানি ধরে রাখার জায়গা কমে যাচ্ছে। জলাভূমি কমে যাওয়ায় বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে শহরের উষ্ণতাও বাড়ছে। জলজ উদ্ভিদের উৎস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জীব-বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। তিনি আরো বলেন, পুকুর রক্ষায় জলাধার সংরক্ষণ আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। সিডিএ, সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে দায়িত্ব নিতে হবে। না হয় বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।

পুকুর কিংবা জলায়শ ভরাট করে ভবন নির্মাণের জন্য অনুমোদন কীভাবে দেওয়া দেয়া এমন প্রশ্নে সিডিএ’র এক কর্মকর্তা জানান, বিএস খতিয়ানে পুকুর কিংবা জলাশয় থাকলেও মাস্টাপ্ল্যানের সময় যদি জমি ভরাট অবস্থায় পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে মাস্টার প্ল্যানে সেটি ভরাট হিসাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। ওই ধরনের জমিতে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়। এছাড়া কোনো জমি বিএস খতিয়ান ও মাস্টারপ্ল্যানে পুকুর হিসেবে উল্লেখ রয়েছে কিন্তু বর্তমানে ভরাট হয়ে গেছে সেক্ষেত্রেও ভরাট হয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ যদি সাড়ে ১২ গন্ডার নিচে হয় তাও ভবন নির্মাণে অনুমোদন পাবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত