মানবাধিকার নেতার পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মুকুল!

প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার

কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় মানবাধিকার সংগঠনের নেতা পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন মনোয়ারুল ইসলাম মুকুল নামের এক ব্যক্তি। পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, তার বিরুদ্ধে অস্ত্রসহ ১১টি মামলা রয়েছে। পুরো দ্বীপজুড়ে অপরাধীদের পৃষ্টপোষকতারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সূত্রে জানা যায়, বিগত ২০১৭ সালের ২২ জুন র‌্যাব-৭, কক্সবাজারের অভিযানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ ধরা পড়েছিলেন মুকুল। র‌্যাব ওই সময় মুকুলের কাছ থেকে উদ্ধার করে ১৯টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৬২১ রাউন্ড গুলি। কুতুবদিয়া থানায় র‌্যাবের দায়েরকৃত অস্ত্র আইনের মামলায় কয়েক মাস কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্তি পেয়ে সে আবারও নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে কুতুবদিয়া থানা ও আদালতে চাঁদা দাবি, অস্ত্র আইন, মারামারি, জমি-দখল-বেদখল ও বিভিন্ন অপরাধে বহু মামলা বিচারাধীন রয়েছে। স্থানীয়দের মতে, মানবাধিকার সংগঠনের নেতা পরিচয় দেওয়ায় প্রতাবশালী মুকুলের বিরুদ্ধে কুতুবদিয়ার কেউ মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে নানাভাবে হয়রানি করে থাকে মুকুল ও তার লোকজন। মুকুল এখন কুতুবদিয়া দ্বীপের অঘোষিত ‘মুকুটহীন’ সম্রাট।

কুতুবদিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল এলাকার প্রয়াত জাবের আহমদের ছেলে মনোয়ারুল ইসলাম মুকুল বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের কক্সবাজার জেলা উত্তর শাখার সভাপতি দাবি করে কুতুবদিয়াজুড়ে শালিস বাণিজ্য, নিরীহ লোকের জমি দখল-বেদখল, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন।

বিষয়টি জেনে এর আগে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি কানিজ ফাতেমা মোস্তাক, যুগ্ম সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, মনোয়ারুল ইসলাম মুকুল মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট নয়।

কুতুবদিয়া উপজেলা সদরে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় খুলে বসে সেখানে শালিস বাণিজ্যে চালিয়ে যাচ্ছেন অপ্রতিরোধ্য মুকুল। অভিযোগ রয়েছে, মুকুলের বিরুদ্ধে পুলিশসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মিথ্যা মামলা ও তার অনুগত লোকদের বাদী-অভিযোগকারী সাজিয়ে প্রশাসনের দপ্তরে অভিযোগ দিয়ে হয়রানি করে থাকে।

মুকুল কোনো রাজনৈতিক দলীয় কর্মী নয় বলে কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ থানাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে অবহিত করে রেখেছেন। উল্লেখ্য, তার পিতা জাবের আহমেদ স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কুতুবদিয়া উপজেলা শান্তি কমিটির নেতা ছিলেন।

সূত্র মতে, বিগত ২০১৬ সালের ২৬ নভেম্বর ভূমিহীনদের জমি দখল করতে গেলে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ফরিদুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে স্থানীয় জনতা একট্টা হয়ে মনোয়ারুল ইসলাম মুকুল ও তার পাঁচ সহযোগীকে পিটুনি দেয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিগত ২০১৭ সালের মে মাসে বড়ঘোপ ইউনিয়নের আজম কলোনি এলাকায় কয়েকটি ভূমিহীন পরিবারের জমি দখলে নিতে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় মুকুলের লোকজন।

জেলা পুলিশ সূত্র জানা গেছে, মুকুলের বিরুদ্ধে অস্ত্র, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও ভূমিদস্যুতার অপরাধে ১১টি মামলা রয়েছে। স্থানীয় লোকজন জানান, এলাকার মেম্বার-চেয়ারম্যান, পুলিশ কর্মকর্তা এবং ইউএনও’র বিরুদ্ধেও বিভিন্ন আদালতে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মুকুলের কথা মতো থানায় মামলা রেকর্ড না করলে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে মিথ্যা অভিযোগ দেয়ারও নজির রয়েছে। কুতুবদিয়া থানার সাবেক ওসি দিদারুল ফেরদৌসের বিরুদ্ধেও মিথ্যা মামলা দায়ের করেছিলেন তিনি। বর্তমান ওসি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন লোকজনকে বাদী-অভিযোগকারী সাজিয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে তাকে হয়রানি করছেন।

কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওরঙ্গজেব মাতবর সাংবাদিকদের বলেন, মনোয়ারুল ইসলাম মুকুলের বিরুদ্ধে অনেক অপরাধ কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। তার অত্যাচারে দ্বীপের মানুষ অতিষ্ঠ। আমরা এর পরিত্রাণ চেয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

স্থানীয়দের মতে, মুকুলের কোনো নির্দিষ্ট পেশা নেই। তিনি থানা এলাকায় সংগঠিত বিভিন্ন ঘটনায় শালিস-বিচার করেন। দুইপক্ষ থেকে টাকা জমা নেন। কোনো পক্ষ তার তার শালিস না মানলে অপর পক্ষের মাধ্যমে থানায় বিভিন্ন নিরীহ লোকজনকে আসামি করে অভিযোগ করান। আর এসব ঘটনা মামলা না নিলে পুলিশের বিরুদ্ধে শুরু করে নানা চক্রান্ত।

কুতুবদিয়া দ্বীপের কৈয়ারবিল ইউনিয়নের কায়েস উদ্দিন বলেন, উত্তর ধুরং এলাকার রাহমত উল্লাহর পুত্র কামাল হোসেন (৪২) চলতি বছরের ৬ জুন কুতুবদিয়া থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলায় আমাকে আসামি করা হয়। পরে বাদীর সঙ্গে আমি যোগাযোগ করলে আমাকে জানায়, মামলার এজাহারে মুকুল তার নাম দিয়েছিল। ভুক্তভোগী কায়েস বলেন, গত ৬ মে কুতুবদিয়া থানায় জনৈক শিবু দাশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। সেই মামলাও মুকুল আমাকে আসামি করে।

পরে মামলার বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারি, মুকুল তাকে আসামি করার জন্য শিবুর অজান্তে এজাহারে কৌশলে নাম দিয়েছিল।

কুতুবদিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের মৌলভী পাড়া গ্রামের আব্বাস উদ্দিনের স্ত্রী বেবি আক্তার (৩০) অভিযোগ করে বলেন, মানবাধিকার নেতা পরিচয়ধারী মুকুলের ইন্ধনে আদালতের রায় অমান্য করে আমার বসতবাড়িতে গত ১৩ জুলাই হামলা ও ব্যাপক ভাঙচুর চালায় একদল লোক। এ ঘটনা নিয়ে আমি বাদী হয়ে কুতুবদিয়া থানায় মামলা করেছি। মামলার এজাহারে আমার বাড়িতে হামলার ঘটনায় জড়িত মুকুলের বিষয়ে তুলে ধরেছি।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, মুকুলের দৃশ্যমান কোনো আয়-রোজগার না থাকা সত্ত্বেও মুকুল তিনটি জীপ গাড়ি ব্যবহার করেন। তার ইনকাম সোর্স রহস্যজনক।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে অভিযুক্ত মনোয়ারুল ইসলাম মুকুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে সব মামলাই ষড়যন্ত্রমূলক। আমি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নেই। একটি মহল আমার বিরুদ্ধে প্রায় নানামুখী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আমাকে হয়রানি করে। এই প্রসঙ্গে কুতুবদিয়ার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, মনোরুল ইসলাম মুকুল নামের এক ব্যক্তি কুতুবদিয়াজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তার বিরুদ্ধে অহরহ অভিযোগ রয়েছে। থানা পুলিশ তার কথামতো মিথ্যা মামলা রেকর্ড না করলে পুলিশের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার শুরু করে। মুকুলের এহেন অপরাধ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অবহিত করা হয়েছে।