চট্টগ্রাম নগরীতে তীব্র গণপরিবহন সংকট
নাগরিক ভোগান্তি : * ৭৭ হাজার ৪৯৩টি যানবাহনের ফিটনেস নেই। * অনুমোদনহীন সিএনজি চলাচল করছে অন্তত ১০ হাজার। এসব অনুমোদনহীন যানবাহনের কারণে নগরীতে বাড়ছে যানজট। * চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত ১০০টি গাড়ির সিলিং থাকলেও এ রুটে চলাচল করছে সবগুলো মিনিবাস।
প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সাইফুদ্দিন তুহিন, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলছে তীব্র গণপরিবহন সংকট। প্রধান সড়কগুলোতে গণপরিবহন চলছে প্রয়োজনের তুলনায় কম। এজন্য চরম দুর্ভোগে আছে নগরবাসী। সড়কে নামছে না নতুন বাস-মিনিবাস। যেগুলো আছে তার বেশিরভাগই লক্কড়-ঝক্কড়, ফিটনেস পারমিটবিহীন। আবার বেশকিছু গণপরিবহন ব্যস্ত থাকে কলকারখানায় শ্রমিক আনা-নেওয়ার কাজে। গণপরিবহনগুলোর একটি বড় অংশ চলে ‘রিজার্ভ’ স্টিকার লাগিয়ে। যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে উঠতে চাইলেও রিজার্ভ দেখে হতাশ হন। এতে অফিস সময়ে নষ্ট হয় কর্মঘণ্টা। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় রাস্তার মোড়ে মোড়ে। চট্টগ্রাম বিআরটিএ’র বিভাগীয় কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রামে নগরী ও জেলা মিলে মোট অনুমোদিত যানবাহনের সংখ্যা ৪ লাখ ২৯ হাজার ১৮৮টি। এর মধ্যে নগরীতে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯৩৭টি এবং জেলায় ৬৯ হাজার ২৫১টি যানবাহনের অনুমোদন আছে। এসব যানবাহনের মধ্যে নগরীতে ৫০ হাজার ৮৭টি এবং জেলার ২৭ হাজার ৪০৬টিসহ মোট ৭৭ হাজার ৪৯৩টি যানবাহনের ফিটনেস নেই। নগরীতে বাস-মিনিবাসের অনুমোদন আছে ১ হাজার ১৩০টি; আর টেম্পু ২ হাজার ১৫৮টি, হিউম্যান হলার ৯৬৯টি এবং ১৩ হাজার সিএনজি অটোরিকশার অনুমোদন আছে। চট্টগ্রাম মহানগর অটোরিকশা-অটোটেম্পু মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক টিটু চৌধুরী বলেন, নগরীতে দীর্ঘদিন ধরেই চলছে গণপরিবহন সংকট। নতুন বাস-মিনিবাস সড়কে নামছে না, বরং কমেছে। হাতেগোনা কয়েকটি রুট ছাড়া বাকিগুলোতে বাস-মিনিবাস চলাচল করছে না। বাস-মিনিবাসের পরিবর্তে এসব রুটে চলাচল করছে হিউম্যান হলার। এসব দিয়েই তো আর যানবাহন সংকট সামাল দেয়া যাবে না। নগরীতে অনুমোদনহীন ছোট যানবাহনের সংখ্যাও কম নয়। গণপরিবহন সংকটের কারণে ছোট পরিবহণগুলোর কদর বেড়েছে। নগরীতে অন্তত ২ লাখ রিকশা চলাচল করছে। এর বাইরে ব্যাটারিচালিত টমটম আছে ৪ থেকে ৫ হাজার, নগরীর ১৬টি থানা এলাকায় অন্তত ৫০ হাজারের বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে। এর বাইরে অনুমোদনহীন সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করছে অন্তত ১০ হাজার। এসব অনুমোদনহীন যানবাহনের কারণে নগরীতে বাড়ছে যানজট। সেই সঙ্গে শৃঙ্খলা হারাচ্ছে সড়ক। নগরীর বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা আবুল মনসুর বলেন, চট্টগ্রাম নগরীতে গণপরিবহন সংকট দীর্ঘদিনের। যেসব পরিবহণ আছে, সেগুলো ঠাসাঠাসি করে যাত্রী পরিবহণ করছে। যে পরিমাণ সিট আছে, তার চেয়ে বেশি দাঁড় করিয়ে যাত্রী তোলা হয়। যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করছে। যাত্রী নেওয়ার জন্য আছে একই রুটের গাড়ির সঙ্গে আরেক গাড়ির প্রতিযোগিতা। সেই সঙ্গে চলে টোকেন বাণিজ্য। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম নগরীতে বাস-মিনিবাস চলাচলের জন্য ১৭টি রুট নির্ধারণ করা আছে। এসব রুটে ১ হাজার ৫৪৫টি গাড়ি চলাচলের সিলিং রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ১৭৫টি গাড়ির রুট পারমিট দেওয়া হয়েছে।
তবে বর্তমানে ৪৫০টির বেশি গাড়ি এসব রুটে চলাচল করছে না। বাকি গাড়ির মধ্যে কিছু নষ্ট হয়ে আছে। কিছু গাড়ি কলকারখানায় শ্রমিক আনা- নেওয়াসহ রিজার্ভ ভাড়ায় নিয়োজিত। সম্প্রতি নগরীর বাস-মিনিবাস রুটগুলোতে কী পরিমাণ গণপরিবহন চলাচল করছে, তার ওপর একটি জরিপ করেছে সিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। ওই জরিপের তথ্য অনুযায়ী, নগরীর কর্ণফুলী ব্রিজ থেকে চকবাজার হয়ে কোতোয়ালি মোড় পর্যন্ত ১ নম্বর রুট। এ রুটে ১০০টি বাস-মিনিবাস চলাচলের সিলিং নির্ধারণ করা আছে। এর মধ্যে ৪৩টি গাড়ির রুট পারমিটও দেওয়া হয়। অথচ কয়েক বছর ধরে এ রুটে একটি বাস-মিনিবাসও চলাচল করছে না। বন্ধ হয়ে আছে রুটটি। ফলে এ রুটে ছোট গাড়ি মাহিন্দ্রা, হিউম্যান হলার, টুকটুকি (টেম্পো) গাড়িই যাত্রীদের একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
এভাবে গণপরিবহন সংকটে অন্তত পাঁচটি রুট বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি রুটগুলোর মধ্যে কালুরঘাট ব্রিজ থেকে ষোলশহর, প্রবর্তক মোড় হয়ে বিআরটিসি পর্যন্ত ২ নম্বর রুট। এ রুটে ৭৫টি গাড়ির সিলিং থাকলেও ৪৫টি গাড়ির রুট পারমিট দেওয়া হয়। এ রুটটিও গত কয়েক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে জিপিও থেকে পটিয়া হয়ে চন্দনাইশ বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত ১৩ নম্বর রুট। এ রুটে ৩০টি গাড়ির সিলিং থাকলেও এখন পর্যন্ত একটি গাড়িরও রুট পারমিট দেওয়া হয়নি। ফলে শুরুই করা যায়নি রুটটি।
কয়েক বছর আগে নগরীতে ঘটাও করে উদ্বোধন করা হয় প্রিমিয়ার ট্রান্সপোর্ট নামে এসি বাস সার্ভিস। কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে সি-বিচ পর্যন্ত এসি বাস সার্ভিসের ১৪ নম্বর এ রুটে ২০টি গাড়ির সিলিং নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে চারটি গাড়ির পারমিট দেওয়া হয়। এখন সেগুলোও আর চলে না। কুয়াইশ কানেকটিং রোডের মুখ থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ১৬ নম্বর রুট। এ রুটের জন্য ৩০টি গাড়ির সিলিং নির্ধারণ করা হয়। অথচ এখনো চালু করা যায়নি রুটটি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত ৩ নম্বর রুটে ১০০টি গাড়ির সিলিং থাকলেও এ রুটে চলাচল করছে সবগুলো মিনিবাস।
এছাড়া সীতাকুন্ডের ভাটিয়ারী থেকে টাইগারপাস পর্যন্ত ৪ নম্বর রুটে ১৫০টি গাড়ির সিলিংয়ের মধ্যে পারমিট আছে ১৩২টির, চলাচল করে মাত্র ৬০ থেকে ৬৫টি। বিমানবন্দর থেকে লালদীঘি পর্যন্ত ৫ নম্বর রুট। এ রুটে ৭৫টি গাড়ির সিলিং, সবগুলোরই রুট পারমিট দেওয়া হয়। এ রুটটিও এখন বন্ধ রয়েছে। সি-বিচ থেকে লালদীঘির পাড় পর্যন্ত ৬ নম্বর রুট। এ রুটে ১৫০টি গাড়ির সিলিংয়ের মধ্যে রুট পারমিট আছে ১৫০টির। চলাচল করে মাত্র ৮০ থেকে ৯০টি।
ভাটিয়ারী থেকে বড়পুল, বাদামতলী হয়ে আটমার্সিং পর্যন্ত ৭ নম্বর রুট। এ রুটে ১২৫টি গাড়ির সিলিং থাকলেও পারমিট আছে ১০৭টির, বর্তমানে চলাচল করছে ৫৫ থেকে ৬০টি গাড়ি। অক্সিজেন থেকে টাইগারপাস-লালদীঘি পর্যন্ত ৮ নম্বর রুট। এ রুটে ৭৫টি গাড়ির সিলিং থাকলেও রুট পারমিট আছে ৩৯টির, চলছে ১৫ থেকে ১৬টি গাড়ি।
কালুরঘাট থেকে সি-বিচ পর্যন্ত ১০ নম্বর রুট। এ রুটে ২০৫টি গাড়ির সিলিং থাকলেও রুট পারমিট আছে ১৯৭টির, চলছে ১১০ থেকে ১১৫টি। ভাটিয়ারী থেকে পোর্টকানেকটিং রুট হয়ে সি-বিচ পর্যন্ত ১১ নম্বর রুটে ১২৫টি গাড়ির সিলিং থাকলেও পারমিট আছে ১২৫টির, চলছে ৮০থেকে ৮৫টি। কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে বহদ্দারহাট হয়ে সি-বিচ পর্যন্ত ১৫ নম্বর রুটে ৫৫টি গাড়ির সিলিং থাকলেও সমপরিমাণ গাড়ির রুট পারমিট আছে। এ রুটে সব গাড়িই চলছে।
নিমতলা, বড়পুল হয়ে সীতাকুন্ডের বড় দারোগার হাট পর্যন্ত ১৭ রুটে ৩০টি গাড়ির সিলিং থাকলেও পারমিট আছে ২০টির। তবে এ সড়কে রুট পরিবর্তন করে অলংকার মোড় থেকে গাড়ি চলাচল করে।
অন্যদিকে ইপিজেডে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য রিজার্ভ স্টাফ বাস চলাচলের জন্য ২০০টি সিলিং নির্ধারণ করা আছে। এর মধ্যে রুট পারমিট আছে ৯৩টির। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহণ মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, নগরীর সড়কগুলোতে যানবাহনের প্রয়োজন অনেক বেশি। কিন্তু সেই পরিমাণ যানবাহন বিশেষ করে গণপরিবহণ চলে না।
নতুন গাড়িও সড়কে দীর্ঘ দিন ধরে নামছে না। তার ওপর যেসব গাড়ির ইকোনমিক লাইফটাইম ২০ বছর করার কারণে বিআরটিএ এসব গাড়ির ফিটনেস পারমিট দিচ্ছে না। এ কারণেই অনেক গাড়ি সড়ক থেকে ছিটকে পড়েছে। আবার করোনা মহামারিতে দীর্ঘদিন গাড়ি চলাচল বন্ধ ছিল। বন্ধ থাকার কারণে অনেক গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। সেগুলো মেরামতের সামর্থ্য অনেক মালিকের নেই। এ কারণে এসব গাড়ি স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করতে হচ্ছে।