বিশ্বের ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার। পাহাড়পুরকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধবিহার বলা হয়। আয়তনে এর সঙ্গে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা করা হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় ২০২২-২৩ রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এক কোটি ৯ লাখ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। তবে বিহারের বাইরে যদি আবাসন/আবাসিকের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজস্ব আয় আরো বেশি হবে।
জানা গেছে, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। আকর্ষণীয় স্থাপত্য বিশাল আয়তন ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার আজ বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। প্রতিদিন এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটক ও সাধারণ মানুষের সমাগম হয়ে থাকে। ঐতিহাসিক এই মহাবিহারটি এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ বিহার বলে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে।
পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন। ১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়। এটি বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্মচর্চা কেন্দ্র ছিল। শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই নয়, চীন, তিব্বত, মিয়ানমার (তদানীন্তন ব্রহ্মদেশ), মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বৌদ্ধরা এখানে ধর্মচর্চা ও ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন। খ্রিষ্টীয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিলো অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। পাহাড়পুরে সীমানা দেয়াল বরাবর অভ্যন্তর ভাগে সারিবদ্ধ ছোট ছোট কক্ষ রয়েছে। উত্তর দিকের বাহুতে ৪৫টি এবং অন্য তিন দিকের বাহুতে রয়েছে ৪৪টি করে কক্ষ। কক্ষগুলোর প্রতিটিতে দরজা আছে। এই দরজাগুলো ভেতরের দিকে প্রশস্ত কিন্তু বাইরের দিকে সরু হয়ে গেছে।
আয়তনে এর সঙ্গে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা করা হয়। মোট ৭০ দশমিক ৩১ একর জমির ওপর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারটি অবস্থিত। বিহারটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্মচর্চা কেন্দ্র ছিল।
পাহাড়পুর সংলগ্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত উল্লেখযোগ্য মূর্তি- বেলে পাথরের চামুন্ডা মূর্তি, লাল পাথরের দণ্ডায়মান শীতলা মূর্তি, কৃষ্ণ পাথরের বিষ্ণুর খণ্ডাংশ, কৃষ্ণ পাথরের দণ্ডায়মান গণেশ, বেলে পাথরের কীর্তি মূর্তি, দুবলহাটির মহারানীর তৈলচিত্র, হরগৌরীর ক্ষতিগ্রস্ত মূর্তি, কৃষ্ণ পাথরের লক্ষ্মী, নারায়ণের ভগ্ন মূর্তি, কৃষ্ণ পাথরের উমা মূর্তি, বেলে পাথরের গৌরী মূর্তি, বেলে পাথরের বিষ্ণু মূর্তি, নন্দী মূর্তি, কৃষ্ণ পাথরের বিষ্ণু মূর্তি, সূর্য মূর্তি। রোববার ঢাকা থেকে বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন আদনান। তিনি বলেন- রাজধানী আইডিয়াল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম বর্ষে পড়াশুনা করছি। পাঠ্য বইতে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের বিষয়ে পড়েছি। ইন্টারনেটে ভিডিও দেখেছি। কিন্তু বাস্তবে দেখার জন্য এসেছি। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় তেমন সমস্যায় পড়তে হয়নি। তবে বাজার থেকে সামান্য রাস্তায় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক রয়েছে। যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এটা সংশোধন করা প্রয়োজন বলে মনে করি। নাটোর জেলার বাসিন্দা রাফিল আহমেদ। পড়াশুনা করে ঢাকা সরকারি বিজ্ঞান কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় বর্ষে।
তিনি বলেন- পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে সরকারিভাবে যে গেস্ট হাউজ আছে তা হয়তো সবার জন্য পাওয়া সম্ভব নয়। যদি বিহারের আশপাশে ব্যক্তিগত কিছু আবাসিক গড়ে উঠতো তাহলে পর্যটকদের জন্য
সুবিধা হতো। দূরদূরান্ত থেকে অনেক পর্যটক এসে ক্লান্ত হয়ে যায়। অনেকে পরিবার নিয়ে আসে। আবাসিক ব্যবস্থা থাকলে কিছুটা জিরিয়ে নিতে পারত।
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম আরজু বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯৩ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর বিপরীতে অর্র্জিত হয়েছে এক কোটি ৯ লাখ টাকা। বিগত যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় দর্শনার্থী বৃদ্ধি পেয়েছে। সারা বছরে যে পরিমাণ রাজস্ব আয় হয় দুই ঈদে তার চেয়ে বেশি আয় হয়। নিরাপত্তা (সিকিউরিটি) ব্যবস্থা অনেক ভালো আছে। রাস্তার সমস্যার বিষয়ে তিনি বলেন- পাহাড়পুর বাজার থেকে বৌদ্ধ বিহারের প্রধান দরজা (মূল গেট) পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তাটি সরু এবং ১১টি বাঁক। যা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। রাস্তা বাঁক ও সরু হওয়ার কারণে অনেক সমস্যা এবং যানজট হয়। বিহারের উত্তরপাশে বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে সোজা নতুন রাস্তা হওয়ার কথা রয়েছে। উত্তরপাশে প্রধান একটি দরজাও হবে। যদি রাস্তাটি প্রশস্থ করাসহ সোজা হতো তাহলে এ সমস্যা আর থাকত না।