কক্সবাজারে আবাসিক হোটেল কক্ষে আওয়ামী লীগের নেতা সাইফুদ্দিনকে উপর্যুপুরি ছুরিকাঘাত করে হত্যার নেপথ্যে ‘নৈতিক স্খলন জনিত অপরাধ’ ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে কক্সবাজার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম এমন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, নৈতিক স্খলনজনিত কারণে অনৈতিক একটি সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন সাইফুদ্দিন ও আটক আশরাফুল ইসলাম, যার কিছু অংশ মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করা হয়। আর এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে টাকা বিনিময়ের একটা চুক্তি ছিল। চুক্তি মতে টাকা পরিশোধ না করা, ভিডিও ধারণ করায় প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠে এ হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করেন আশরাফুল। আশরাফুল ইসলামকে আটকের পর পুলিশ নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ করেছে প্রাথমিক যে তথ্য প্রকাশ করেছেন, তাতে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশ বিষয়টি আরো অধিকতর তদন্ত করছেন বলে জানান পুলিশ সুপার। তিনি জানান, সাইফুদ্দিন ও আশরাফুলের পরিচয় খুব বেশি দিনের না। খুব বেশি হলে এক সপ্তাহের পরিচয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে মোবাইল ফোনে আলাপ, ফেসবুকে কথা বলার পর ২০ আগস্ট দুইজন প্রথম দেখা করে। সাইফুদ্দিন তার মোটর সাইকেলের পেছনে বসিয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান। একপর্যায়ে কয়েকটি পেয়ারা ও এক বোতল চোলাই মদ নিয়ে বিকালে দুইজন আবাসিক হোটেল সানমুনের দ্বিতীয় তলার ২০৮ নম্বর কক্ষে যান। ওখানে অনৈতিক সম্পর্কটি হয়। এরপর হোটেল থেকে বের হয়ে মোটরসাইকেলেযোগে দুইজন শহরের লাল দীঘির পাড়ের এলাকা আসেন। এরপর আশরাফুলকে মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে দিয়ে এক শত টাকা চলে যেতে বলেন। ওই সময় টাকার বিষয়টি নিয়ে তর্ক হলেও আশরাফুলের চলে যায়।
এরপর সাইফুদ্দিন হোটেলে ফিরে যান এবং ঘণ্টা খানিক পর আবারও আশরাফুলকে ফোন করে হোটেলে আসতে বলেন এবং না আসলে ভিডিও প্রচারের হুমকি দেন উল্লেখ করে এসপি বলেন, এবার আশরাফুল আসার সময় ছাকু সাথে নিয়ে আসে। কক্ষে প্রবেশ করে দুইজন তর্ক এবং হাতাহাতিতে জড়িয়ে যান। এতে আশরাফুল উপর্যুপুরি ছুরিকাঘাত করলে সাইফুদ্দিন খাটে পড়ে যান। ওই সময় গলা থেকে শব্দ হওয়ায় বালিশ এবং বিছানার চাদর নিয়ে মাথা চেপে ধরে এবং সাইফুদ্দিনের প্যান্টের ব্যাল্ড দিয়ে হাত বেঁধে দেন। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর আশরাফুল তার হাতে থাকা রক্তের চিহ্ন ধুয়ে সাইফুদ্দিনের মোবাইল ও মোটরসাইকেলের চবি নিয়ে কক্ষ থেকে বের হয়। তারপর মোটরসাইকেল যোগে পালিয়ে যায়।
হোটেল থেকে সংগ্রহ করা ভিডিও ফুটেজ দেখে ঘটনায় পুলিশ সাতজনকে নানাভাবে জিজ্ঞাসা এবং প্রযুক্তির সহায়তায় আশরাফুলকে শনাক্ত করেছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার।
তিনি বলেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে ভিত্তিতে সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির সামনে অস্থায়ী তল্লাশি চৌকি স্থাপন করা হয়। টেকনাফমুখী একটি বাসে তল্লাশির সময় পুলিশ আশরাফুল ইসলাম আটক করে। আশরাফুলের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যার ব্যবহৃত ছাকু, মোবাইল এবং মোটরসাইকেলের চবিটি একটি নর্দমা থেকে উদ্ধার করা হয়। একই সঙ্গে মোটর সাইকেলটিও উদ্ধার করেছে। এব্যাপারে মামলার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
পুলিশ সুপার বলেছেন, সাইফুদ্দিনের শরীরের অন্যান্য আঘাতের চিহ্ন ছাড়া ১৭টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পেয়েছে পুলিশ। আর পুরো হত্যার মিশনে অংশ নিয়েছেন সিসিটিভির ফুটেজে শনাক্ত হওয়া আশরাফুল ইসলাম নামের এই ছেলেটি একা। আশরাফুলও এমন বিষয়টি জানিয়েছে। তারপরও ঘটনার নেপথ্যে অন্য কিছু রয়েছে কি না, তদন্ত করা হচ্ছে।
নিহতের সাইফুদ্দিন কক্সবাজার শহরের ঘোনার পাড়ার অবসরপ্রাপ্ত আনসার কমান্ডার আবুল বশরের ছেলে। তিনি কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক এবং কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের এক সময়ের সহ-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি কাদেরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতিও।
গত সোমবার সকালে কক্সবাজার শহরের হলিডের মোড় সংলগ্ন আবাসিক হোটেল সানমুনের দ্বিতীয় তলার ২০৮ নম্বর কক্ষ থেকে হাত বাঁধা ও রক্তাক্ত সাইফুদ্দিনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
আশরাফুল কক্সবাজার শহরে দক্ষিণ পাহাড়তলী এলাকার একটি মাদ্রাসার ছাত্র এবং তার পিতা একজন জেলে। স্থানীয়দের দাবি তার পরিবার রোহিঙ্গা। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাকিল আহমদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসীম উদ্দীন চৌধুরী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. মিজানুর রহমান, কক্সবাজার সদর মডেল থানা ভারপ্রাপ্ত (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম, পরিদর্শক (তদন্ত) নাজমুল হুদা।
গতকাল সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হলে কক্সবাজার সদর মডেল থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুদ্দিন হত্যার বিষয় নিয়ে তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো এজাহার জমা দেয়নি। সিসিটিভির ফুটেজের সূত্র ধরে গ্রেপ্তারকৃত আশরাফুল ইসলামকে জবানবন্দি দেয়ার জন্য আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।
আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি আশরাফুলের : এদিকে কক্সবাজারে আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুদ্দিন খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার আসামি আশরাফুল ইসলাম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা সোয়া ৬ টায় জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আসাদ উদ্দিন মো. আসিফের আদালতে এ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন বলে জানান কক্সবাজার সদর থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম। গ্রেপ্তার আশরাফুল ইসলাম কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী ইসলামপুর এলাকার একটি মাদ্রাসার ছাত্র। নিহত সাইফুউদ্দিন (৪৫) কক্সবাজার শহরের দক্ষিণ ঘোনার পাড়ার আবুল বশরের ছেলে। তিনি কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক এবং জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ছিলেন। গত সোমবার সকালে কক্সবাজার শহরের হোটেল হলিডে মোড়ের আবাসিক হোটেল সানমুনের ২০৮ নম্বর কক্ষ থেকে হাত বাঁধা এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতপ্রাপ্ত অবস্থায় আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুদ্দিনের মৃতদেহ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় সোমবার মধ্যরাতে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির সামনে যাত্রীবাহী বাসযোগে পালিয়ে যাওয়ার সময় ঘটনার মূল অভিযুক্ত আশরাফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে। রফিকুল ইসলাম বলেন, আবাসিক হোটেল সানমুন থেকে ঘটনার পরপরই পুলিশ সিসিটিভির কিছু ফুটেজ সংগ্রহ করে। পরে ওই ফুটেজের সূত্র ধরে অভিযান চালিয়ে টেকনাফ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় খুনের ঘটনার মূল অভিযুক্তকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এরপর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গ্রেপ্তার আসামিকে কক্সবাজার সদরের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আসাদ উদ্দিন মো. আসিফের আদালতে নেওয়া হয়। সন্ধ্যা সোয়া থেকে বিচারকের কাছে আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান শুরু হয়। এই রিপোট লেখা পর্যন্ত এখনো (রাত ৮ টা) তার জবানবন্দি প্রদান অব্যাহত রয়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান শেষে গ্রেপ্তার আসামিকে কক্সবাজার জেলা কারাগারে প্রেরণ করা হবে বলে জানান সদর থানার ওসি। আওয়ামী লীগ নেতা খুনের ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় লিখিত অভিযোগ জমা না দেওয়ায় এখনো মামলা নথিভুক্ত হয়নি বলে জানান সদর থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম।