প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান নিহত

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা প্রশ্ন, বিচার-বিশ্লেষণ

প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

রাশিয়ায় প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে ভাড়াটে সেনাবাহিনী ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগিনি প্রিগোজিন নিহত হয়েছেন। প্লেনটিতে ১০ জন আরোহী ছিলেন এবং তারা কেউই প্রাণে বেঁচে নেই। নিহতদের মধ্যে ইয়েভগিনি প্রিগোজিনের নামও রয়েছে। রুশ কর্তৃপক্ষ জানায়, মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবাগ যাওয়ার সময় রাশিয়ার টিভের অঞ্চলে বিধ্বস্ত হওয়া প্লেনের যাত্রীদের তালিকায় প্রিগোজিনের নামও ছিল। তবে রাশিয়ার জরুরি মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে প্লেনটি ছিল প্রিগোজিনের ব্যক্তিগত এবং এটি বিধ্বস্ত হলে সকল আরোহী নিহত হন। তবে ওয়াগনারের ঘনিষ্ঠ টেলিগ্রাম চ্যানেল গ্রে জোন জানিয়েছে, মস্কোর উত্তরে টিভের অঞ্চলে প্লেনটিকে গুলি করে নামানো হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা দুর্ঘটনার আগে দুটি বিস্ফোরণের মতো শব্দ পান, এরপর ধোঁয়ার দুটি রেখা তারা দেখতে পান। প্লেন বিধবস্তের ঘটনায় তদন্ত এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। প্লেনটি উড্ডয়নের আধাঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত হওয়ার পর ওই উড়োজাহাজে আগুন ধরে যায়। বিমান দুর্ঘটনায় প্রিগোজিন নিহত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেবল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমই নয়, যেসব মানুষ চলমান রাশিয়া-্ইউক্রেন যুদ্ধের খবর পর্যালোচন করছেন, তারা প্রিগোজিনের নিহত হওয়ার খবরটি অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন। কেন না, ইউক্রেনের সৈন্যদের বিরুদ্ধে রুশ সৈন্যদের হয়ে যুদ্ধ করে আসছি ওয়াগনার গ্রুপের সৈন্যরা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের একসময়ে ঘনিষ্ঠজন প্রিগোজিন ইউক্রেন যুদ্ধে তার সৈন্যদের ব্যবহার করে। সে কারণে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে প্রিগোজিনের একটা সু সম্পর্ক গড়ে উঠলেও ঘটনা বাক নিতে শুরু করে গত জুন মাসে। এ সময় প্রিগোজিন রুশ সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি ব্যর্থ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। ওই সময় প্রিগোজিন রাশিয়ার পাশের কোনো একটি দেশে আশ্রয় নেন বলে গণমাধ্যমের খবরে উঠে এসেছি। এরপর একপ্রকার লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান তিনি। তবে জুলাইয়ের ২০ তারিখে প্রথমবারের মতো জনসম্মুখে আসেন তিনি। প্রিগোজিন নিহত হওয়ার খবরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তেমন একটা অবাক হননি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বিষয়টিকে প্রিগোজিনের ‘অনিবার্য নিয়তি’ বলে মনে করেন। তারা সবাই এই মর্মে একমত হয়েছেন যে, প্রেসিডেন্ট পুতিন তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এমন প্রতিশোধই নিয়ে থাকেন। কেন না, ব্যক্তিগত যে প্লেনটিতে প্রিগোজিন ভ্রমণ করছিলেন সেটি ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে ভূ-পাতিত করা হয় বলে ইতোমধ্যে অভিযোগ উঠেছে।

রুশ উড়োজাহাজ চলাচল সংস্থা বিধ্বস্ত উড়োজাহাজের আরোহী হিসেবে প্রিগোজিনের থাকার বিষয়টি জানালেও প্রিগোজিনের নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেনি সংস্থাটি। প্রিগোজিনের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তাৎক্ষনিকভাবে সেটা ক্রেমলিন বা রাশিয়ার প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকেও নিশ্চিত করা হয়নি। প্লেন দুর্ঘটনায় ইভজেনি প্রিগোজিনের মৃত্যুর খবরে অবাক হননি বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, গত জুনে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পর ওয়াগনারপ্রধানের এমন পরিণতি ‘অনিবার্য’ হয়ে উঠেছিল। কারণ, পুতিন কখনো বেঈমানদের ক্ষমা করেন না। যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৬-এর রাশিয়া ডেস্কের সাবেক প্রধান ক্রিস্টোফার স্টিল জানিয়েছেন, প্লেন দুর্ঘটনাটি সম্ভবত রুশ নিরাপত্তাব্যবস্থার উচ্চপদস্থ কারো নির্দেশে সংঘটিত হয়েছে। হয়তো এতে পুতিনের ‘নীরব সম্মতি’ ছিল। ক্রিস্টোফার বলেন, কয়েক সপ্তাহ আগে আমাদের আগে বলা হয়েছিল, রাশিয়ায় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের মধ্যে প্রিগোজিনের বিষয়ে একটি চুক্তি হয়েছে। সুতরাং, তার প্রচুর শত্রু ছিল। আসলে রুশ প্রশাসনের ভেতরে প্রিগোজিনের মিত্র ছিল খুবই কম এবং এভাবে তার মৃত্যু হবে, এটি অনিবার্যই ছিল। সিআইএ’র সাবেক মস্কো স্টেশন চিফ ড্যানিয়েল হফম্যান বলেছেন, এটি যে পুতিনের নির্দেশে হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই তার। হফম্যান বলেছেন, তার বিশ্বাস, গত জুনে ব্যর্থ বিদ্রোহের পরেও প্রিগোজিনকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। কারণ, এটি তাকে এক ধরনের ভুল নিরাপত্তাবোধ বা চলাফেরার স্বাধীনতা দিতো, যার মাধ্যমে তাকে নিশানা করা যেত।

দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিরক্ষা সম্পাদক শশাঙ্ক যোশি বলেছেন, বিশ্বাসঘাতকতাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ইতিহাস রয়েছে রুশ সরকারের। আর সেটি করা হয় প্রকাশ্যেই। ব্রিটিশ এমপি অ্যালিসিয়া কার্নস বলেছেন, প্লেন দুর্ঘটনার পর রুশ কর্তৃপক্ষ যে দ্রুততার সঙ্গে প্রিগোজিনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে, সেটিই প্রিগোজিনের মৃত্যুর পেছনে সরাসরি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হাত রয়েছে বলে মনে করছেন পশ্চিমা বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, গত জুনে পুতিনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করার পর থেকেই এমন ভয়ংকর পরিণতি ‘অনিবার্য’ হয়ে পড়েছিল প্রিগোজিনের জন্য। ইভজেনি প্রিগোজিনের জন্ম রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে। একই শহরে জন্ম পুতিনেরও। ১৯৭৯ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে প্রথমবার অপরাধী সাব্যস্ত হন প্রিগোজিন। চুরির দায়ে আড়াই বছরের স্থগিত কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। এর দুই বছর পরেই চুরি ও ডাকাতির মামলায় ১৩ বছর কারাদণ্ড হয় প্রিগোজিনের। এর মধ্যে ৯ বছর কারাভোগ করতে হয়েছিল তাকে। কারাভোগ শেষে ব্যবসা শুরু করেন প্রিগোজিন। সেন্ট পিটার্সবার্গে দোকান দিয়ে হট ডগ বিক্রি শুরু করেন তিনি। ব্যবসা বেশ ভালো চলতে শুরু করে। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে অরাজকতার মধ্যেই শহরটিতে একটি বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ চালু করেন প্রিগোজিন। তখন থেকেই বিত্তবান, ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু হয় তার। রেস্তোরাঁর সূত্রেই পরিচয় হয় পুতিনের সঙ্গে। তখন তিনি শহরটির ডেপুটি মেয়র। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেও পুতিন তার বিদেশি অতিথিদের প্রিগোজিনের রেস্তোরাঁয় নিয়ে যেতেন।

এভাবে রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেন প্রিগোজিন। কয়েক বছর পরে তার মালিকানাধীন ক্যাটারিং কোম্পানি কনকর্ড ক্রেমলিনে খাবার সরবরাহের দায়িত্ব পায়। এর মধ্য দিয়ে ‘পুতিনের বাবুর্চি’ বলে পরিচিতি পান প্রিগোজিন। এরপর সামরিক বাহিনী ও সরকারি স্কুলেও খাবার সরবরাহের দায়িত্ব পায় কনকর্ড। ২০০০ সালের পর থেকে নজরকাড়া উত্থান শুরু হয় প্রিগোজিনের। একসঙ্গে একাধিক কোম্পানির মালিক হয়ে যান তিনি। তার কোম্পানিগুলো একচেটিয়াভাবে রুশ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ পেতে শুরু করে। এভাবে বিপুল অর্থ উপার্জন করেন তিনি। ধারণা করা হয়, এই অর্থ দিয়েই ওয়াগনার বাহিনী গড়ে তোলেন প্রিগোজিন। পরে তিনি নিজেই বাহিনীর শীর্ষ নির্বাহী ও কমান্ডার পদে যুক্ত হন। এই বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সম্ভবত চেচনিয়ায় যুদ্ধ করা রুশ সেনা কর্মকর্তা দিমিত্রি উটকিন। তবে এর বড় উত্থান ঘটে প্রিগোজিনের হাত ধরে। ক্রিমিয়া দখলের জন্য ২০১৪ সালের যুদ্ধে রাশিয়ার হয়ে প্রথমবার মাঠে নামে ওয়াগনার গ্রুপ। তখনই এ বাহিনীর অস্তিত্ব টের পায় পুরো বিশ্ব। এরপর ২০১৫ সালে সিরিয়াতে সরকার সমর্থিত বাহিনীর পাশে থেকে যুদ্ধ করে ওয়াগনার বাহিনী। ওই সময় সিরিয়ার তেলের খনিগুলো পাহারা দিতেন এই বাহিনীর সদস্যরা। ইউক্রেন যুদ্ধেও সক্রিয় অংশ নিয়েছে ওয়াগনার গ্রুপ। প্রথম দিকে এই গ্রুপের সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৫ হাজার, যাদের অধিকাংশই ছিল বিভিন্ন রেজিমেন্টের সাবেক সৈন্য। তবে ক্রেমলিন নিয়মিত বাহিনীর জন্য লোক পেতে সমস্যায় পড়ার পর ওয়াগনার বাহিনী বড় সংখ্যায় নিয়োগ দিতে শুরু করে। বর্তমানে তাদের সৈন্যসংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি, যার ৮০ শতাংশই এসেছে রাশিয়ার কারাবন্দিদের মধ্য থেকে। ওয়াগনার প্রধান ইভজেনি প্রিগোজিনের প্লেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর ছড়ানোর সময় নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে সোভিয়েত যুদ্ধজয়ের ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে রাশিয়ার কুরস্ক শহরে একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছিলেন পুতিন। ১৯৪৩ সালের যুদ্ধটি ইতিহাসের বৃহত্তম ট্যাংক যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হয়।

বক্তৃতায় পুতিন প্লেন দুর্ঘটনার কোনো কথা উল্লেখ করেননি। তবে ইউক্রেনে ‘সাহসিকতার ও দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধ করা’ রুশ সৈন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তিনি। রুশ ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইভজেনি প্রিগোজিনের মৃত্যুর খবরে মোটেও আশ্চর্য হননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, যেন এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। এই ঘটনায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হাত থাকতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। প্রিগোজিনের মৃত্যুর খবরের প্রতিক্রিয়ায় বাইডেন সাংবাদিকদের বলেছেন, নিশ্চিত জানি না কী ঘটেছে। তবে আমি আশ্চর্য নই। এর পেছনে পুতিনের হাত থাকতে পারে ইঙ্গিত দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, রাশিয়ায় পুতিনকে বাদ দিয়ে বেশি কিছু ঘটে না। তবে এই মুহূর্তে জবাব দেওয়ার মতো বেশি কিছু আমি জানি না। সূত্র : বিসিসি, আল জাজিরা এনডিটিভি