অন্তহীন খাটুনিতে ছাপা হতো পত্রিকা

কালের সাক্ষী লেটার প্রেস

প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচএম আরিফ, কুষ্টিয়া

একটির পর একটি বর্ণ বসিয়ে শব্দ তৈরি করে অন্তহীন খাটুনিতে লেটার প্রেস বা ট্রেডল মেশিনে ছাপা হতো পত্রিকা। আজকের আধুনিক যুগের আধুনিক অফসেট প্রেসের বদৌলতে পাঠক ঝকঝকে ছাপা পত্রিকা হাতে পেলেও সেই স্বর্ণযুগে পাঠক খুব সহজেই ঝকঝকে ছাপা পত্রিকা পেত না। প্রকাশনার পেছনের কারিগরদের দিন-রাতের পরিশ্রমে বের করতে হতো একটি পত্রিকা। বানান সঠিক তো ভালো; না হলে পাঠকের আর সম্পাদকের বকাবকিতেই মানুষিকভাবে শেষ হয়ে যেত প্রকাশনার পেছনের কারিগরটি। ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়, ছোট একটি টুলে বসে সামনের টেবিলের ডানপাশে, বামপাশে ছোট ছোট অনেক খোপের কাঠের পাত্র থাকত। সেসব খোপে সিসা দিয়ে বানানো উল্টো করে তৈরি বাংলা বা ইংরেজি বর্ণ থাকত। একেকটি খোপে একেক ধরনের বর্ণ থাকত। খোপ থেকে একটি একটি করে বর্ণ তুলে নিতেন। তারপর একটির পর একটি বর্ণ বসিয়ে শব্দ তৈরি করতেন। যেমন- বই লিখতে হলে ‘ব’ বর্ণেও খোপ থেকে ‘ব’ এবং ‘ই’ বর্ণের খোপ থেকে ‘ই’ নিয়ে পাশাপাশি বসিয়ে তৈরি হতো ‘বই’ শব্দটি। এভাবে অনেক শব্দ বসিয়ে একটি বাক্য তৈরি হতো। অনেক বাক্য দিয়ে একটি লেখা তৈরি করে ‘গ্যালি’ নামের একটি কাঠের পাত্রে বর্ণগুলো রাখা হতো। গ্যালিতে রাখা সেসব উল্টো বর্ণের গায়ে রোলার দিয়ে কালি লাগানো হতো। তারপর কালিমাখা সেসব বণের ওপর বিশেষ একটি পদ্ধতিতে নিউজ প্রিন্টের একটি কাগজ চাপ দেওয়া হতো। তখন সেই নিউজ প্রিন্টের কাগজে বর্ণগুলো ফুটে উঠতো। তারপর দেখা হতো বানান ঠিক হয়েছে কি না। ছাপা কাজে ভুল হলে ভুল বর্ণ সরিয়ে সঠিক বর্ণ বসানো হতো। প্রুফ দেখার পর গ্যালিতে সাজানো বর্ণ মেশিনে সেট করে কাগজে ছাপানো হতো। বর্ণ বা লেটার বসিয়ে ছাপার কাজ হতো। এভাবেই কাজ হতো লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিনে। প্রথম দিকে সেসব মুদ্রণযন্ত্র বিদ্যুৎ ছাড়া পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে চালানো হতো। ছাপার কাজ। এরপর সেসব মেশিনে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, কুষ্টিয়া জেলায় সর্বপ্রথম ট্রেডল মেশিন বা লেটারপ্রেসের প্রবর্তন করেন উপমহাদেশের সংবাদপত্রের পথিকৃৎ হরিনাথ মজুমদার ওরফে কাঙাল হরিনাথ। কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর তীরবর্তী কুমারখালী শহরের কুণ্ডুপাড়ায় অভাব-অনটন সত্ত্বেও অবহেলিত সমাজের বৈষম্য এবং জমিদারদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সচেতন করতে ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে কাঙাল হরিনাথ প্রথম মাসিক সংবাদপত্র ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশ করেন। প্রথম দিকে হাতে লিখে পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো। পরে কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নের যন্ত্রে ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ মুদ্রিত ও কুমারখালী থেকে প্রকাশিত হতো। চার ফর্মার এই মাসিক পত্রিকার মূল্য ছিল পাঁচ আনা। শেষ দিকে এক পয়সার সাপ্তাহিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয় এটি। নিঃস্ব কাঙাল হরিনাথ সারাজীবনে সচ্ছলতার মুখ না দেখলেও ১৮৭৩ সালে নিজ গ্রাম কুন্ডুপাড়ায় ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকার নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতা থেকে লেটারপ্রেস কিনে আনেন।

দীর্ঘ ১৮ বছর রাজশাহীর রানি স্বর্ণকুমারী দেবীর অর্থ আনুকূল্যে পত্রিকা চালানোর পর আর্থিক অনটন ও সরকারের মুদ্রণ শাসন ব্যবস্থার কারণে পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। কাঙাল হরিনাথ মজুমদার আজ বেঁচে নেই। কিন্তু তার ঐতিহাসিক সেই ছাপার যন্ত্র, এমএন প্রেস, হাত মেশিন, বাংলা টাইপ ও হরিনাথের কিছু পান্ডুলিপি আজও কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে। বর্তমান সরকার কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি যাদুঘরে স্থানান্তর করে নিয়েছে। যে প্রেসটিতে রয়েছে কাঙাল হরিনাথ, লালন শাহ, মীর মশাররফ হোসেন ও জলধর সেনের হাতের স্পর্শ। বাণিজ্যিকভাবে কুষ্টিয়া জেলায় ব্রিটিশ শাসনামলে দেবন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নামের ব্যক্তি কুষ্টিয়া শহরে প্রথম লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিন স্থাপন করেন। পাকিস্তান আমলে কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়ায় আব্দুল বারী সুলভ প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। ধীরে ধীরে দেওয়ান প্রেস, ন্যাশনাল প্রেস, মুকুল মুদ্রণ, কল্লোল মুদ্রায়ণ, রহমান প্রেস, জিনাত প্রেস, ওয়েসিস প্রিন্টিং প্রেস, টাউন প্রেস, লিয়াকত প্রেস, পপুলার প্রিন্টিং প্রেস, চৌধুরী প্রেস, জাগরণী মুদ্রায়ন, বলাকা প্রেসসহ ২০-২৫টি লেটারপ্রেস গড়ে ওঠে। এসব প্রেস থেকে মূলত বই, পুস্তক, লিফলেট, লেভেল, ক্যাশ মেমো, বিয়ের কার্ড ছাপা হতো। পুরোনো এসব প্রেসের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যারা এই ব্যবসায় টিকে আছেন, নব্বই দশকের পর তারা লেটারপ্রেস ছেড়ে আধুনিক অফসেট প্রেসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। কাঙাল হরিনাথের প্রেসটি ছাড়া কুষ্টিয়া জেলায় এখন একটি মাত্র লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শহরের কোর্টপাড়া এলাকায় কল্লোল মুদ্রায়ন নামের প্রেসে আছে এই লেটারপ্রেস।

প্রবীণ সাংবাদিক কুষ্টিয়ার সর্বপ্রথম দৈনিক পত্রিকা বাংলাদেশ বার্তার সম্পাদক ও অধুনালুপ্ত জাগরণী প্রেসের স্বত্বাধিকারী আবদুর রশীদ চৌধুরী জানান, কুষ্টিয়া থেকে প্রায় ৫৬ বছর আগে তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক জাগরণী পত্রিকা প্রকাশিত হতো। যার প্রকাশনা এখনো অব্যাহত আছে। এরপর তার সম্পাদনায় ইংরেজি উইকলি রিভিউ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। যার প্রকাশনার বয়স প্রায় ৪৫ বছর। পরে একই প্রেস থেকে তার ভাই প্রয়াত সাংবাদিক ওয়ালিউল বারী চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ইস্পাত পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৮৭ সালে এই লেটারপ্রেসেই আবদুর রশীদ চৌধুরীর সম্পাদনায় কুষ্টিয়ার প্রথম দৈনিক পত্রিকা ‘বাংলাদেশ বার্তা’ প্রকাশিত হয়। আবদুর রশীদ চৌধুরী আরো জানান, সে সময় লেটারপ্রেসে পত্রিকা বের করা ছিল ভীষণ খাটুনির কাজ। একটা একটা করে অক্ষর টাইপ করে শব্দ তৈরি করতে হতো। এখনকার মতো ছবি ছাপা যেত না। আগে থেকে কাঠের মধ্যে ব্লক তৈরি করে তারপর ছবি ছাপতে হতো। কথা হয় লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিনে কাজ করা বাবুর সঙ্গে। তিনি এখন কল্লোল মুদ্রায়ন প্রেসে কর্মরত। বাবু জানান, তখন তাদের প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক মজুরি দেওয়া হতো। সাপ্তাহিক মজুরি ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। কে কতটা টাইপ করেছেন সেই হিসাবে তাদের মজুরি দেওয়া হতো। বর্তমানে কুষ্টিয়ায় লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিনে কাজ করা শ্রমিক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অধিকাংশ শ্রমিকই মারা গেছেন। দুয়েকজন যারা আছেন তারাও পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। কুষ্টিয়া শহরের পদ্মা প্রিন্টিং প্রেসের মালিক শহিদুল ইসলাম জানান, ১৯৯০ এর দশকের পর মুদ্রণশিল্পে আধুনিক অফসেট প্রেসের আবির্ভাব ঘটার পর এই লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিনের বিলুপ্তি ঘটতে থাকে। সেই সময়ের ট্রেডল মেশিনের মালিকরা তাদের ব্যবহৃত মেশিনগুলো লোহার দামে ভাঙাড়ি হিসেবে বিক্রি করেছেন। বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলায় কাঙাল হরিনাথের এমএন প্রেসের একটি এবং কল্লোল মুদ্রায়ন প্রেসে সংরক্ষিত লেটারপ্রেসটিই কালের সাক্ষী হয়ে আছে।