বাংলাদেশে আগমনের ছয় বছর
প্রত্যাবাসনে আলোর মুখ দেখেনি রোহিঙ্গারা
ক্যাম্পেই খুন ১৮৯ জন
প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার
২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয় ১০ লাখ রোহিঙ্গা। অল্প সময়ের জন্য আশ্রয় নিলেও এক এক করে আশ্রয় নেওয়ার ৬ বছর পূরণ হয়েছে আজ শুক্রবার। দীর্ঘ ৬ বছরেও প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় একজন রোহিঙ্গাকেও পাঠানো যায়নি মিয়ানমারে। ফলে রোহিঙ্গা আর বাংলাদেশ উভয়ে এখন চরম সংকটে। নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক, পর্যটন খাতসহ এমন কোনো খাত নেই যেখানে প্রভাব পড়েনি। গত ৬ বছরে ক্যাম্পেই খুন হয়েছে ১৮৯ জন। খুন, অপহরণ, মাদক, ডাকাতি এখন আর ক্যাম্পে সীমাবদ্ধ নেই। রোহিঙ্গাদের অপরাধের জাল ছড়িয়ে পড়েছে পুরো কক্সবাজার জুড়ে। রোহিঙ্গারা বলেছেন, ক্যাম্পের বন্দি জীবনে তারাও ভালো নেই। স্বগোত্রীয় সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া অপরাধের কারণে তারাও অতিষ্ঠ। নাগরিকত্ব, নিজেদের গ্রামে পুনর্বাসন এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করলে এখনই চলে যাবেন মিয়ানমারে।
স্থানীয়রা বলেছেন, যে মানবতা রোহিঙ্গাদের প্রতি দেখানো হয়েছিল সেটা তারা ধরে রাখতে পারেনি। এখন প্রত্যেকটি অপরাধে তারা জড়িত হচ্ছে। দ্রুত প্রত্যাবাসন না হলে কক্সবাজারের পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ।
রোহিঙ্গা সংকটের ৬ বছর পার হতে চললেও প্রত্যাবাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। শুধুমাত্র ক্যাম্প পরিদর্শন ও রোহিঙ্গাদের আশ্বস্ত করে দায় সারছেন বিদেশি প্রতিনিধিরা। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সহায়তাও কমছে আশঙ্কাজনক হারে, যার কারণে নানামুখী সংকটসহ অস্থিরতা বাড়ছে কক্সবাজার অঞ্চলে। আর গেল ৬ বছরে ক্যাম্পে নতুন করে জন্ম নিয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার শিশু। তবে এই সংকটের জন্য মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাদের দুষছেন প্রত্যাবাসন সংশ্লিষ্টরা। মোহাম্মদ জোবায়ের, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর তার সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। স্বদেশে ফিরতে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সবসময় চালিয়ে যান আলাপ-আলোচনা। একই সঙ্গে বিদেশি প্রতিনিধি দল আসলেই ছুটে যান তাদের কাছে আর হাতে দেন দাবি-দাওয়া সম্বলিত চিঠি। জোবায়েরের দাবি, বিদেশি প্রতিনিধিরা আসে আর যায়, আশ্বস্তও করেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি ৬ বছরেও। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, ‘ছয় বছর পার হচ্ছে, পরের দেশে এই দীর্ঘ বছর জীবন আমরা করতে চাই না। বাংলাদেশের মানুষ আমাদের আশ্রয় দিয়েছে, সহায়তা করছে। কিন্তু বাংলাদেশে জনসংখ্যা বেশি, আমরা তাদের আর কষ্ট দিতে চাই না। আমরা দ্রুত নিজদেশ মিয়ানমার ফিরে যেতে চাই। মোহাম্মদ জোবায়ের আরো বলেন, ‘আমরা দেশ ছাড়া মানুষ নয়, আমাদের দেশ আছে। মিয়ানমারই হচ্ছে আমাদের জন্মভূমি। এখন আন্তর্জাতিক মহলের কাছে একটায় দাবি, দ্রুত স্বদেশ মিয়ানমারে নাগরিকত্ব, নাগরিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিয়ে যাতে ফেরত পাঠায়।
রোহিঙ্গাদের ফেরাতে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। এরপর দুইবার প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু মিয়ানমারের অনীহায় তা ভেস্তে যায়। এরপর করোনা ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের কারণে দীর্ঘসময় বন্ধ থাকে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা। চলতি বছরে চীনের মধ্যস্থতায় নতুন করে আলোচনায় আসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, যার জন্য চলতি বছরের ১৫ মার্চ রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই করতে টেকনাফ আসে মিয়ানমার প্রতিনিধি দল। প্রতিনিধি দলটি এক সপ্তাহ টেকনাফে অবস্থান করে কয়েক’শ রোহিঙ্গা পরিবারের তালিকা যাচাই-বাছাই করে মিয়ানমারে ফিরে যায়। এরপর ৫ মে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সার্বিক পরিস্থিতি কতটা অনুকূলে তা দেখতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুতে যায় ২০ জন রোহিঙ্গা নাগরিকসহ ২৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। তারপর প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গাদের রাজি করাতে ২৫ মে ফের মিয়ানমার প্রতিনিধি দল আসে টেকনাফে। তারপর কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই মিয়ানমারে ফিরে যায় প্রতিনিধি দলটি। ফলে প্রত্যাবাসনের জন্য নেয়া পালইট প্রকল্পটিরও অগ্রগতি হয়নি। রোহিঙ্গাদের শর্ত আর মিয়ানমারের অনীহার কারণে প্রত্যাবাসনের এ উদ্যোগও আলোর মুখ দেখেনি। টেকনাফ শালবাগান ক্যাম্পের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমরা আমাদের দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই। অবশ্য আমরা ফিরে যাব। শুধুমাত্র আমাদের নাগরিকত্ব ও নিজ ভিটে মাটি ফিরিয়ে দিতে হবে।
টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কমিউনিটি নেতা হামিদুর রহমান বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছি ৬ বছর হচ্ছে। মিয়ানমার সরকার যদি আমাদের মেনে নেয়, নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিলে শতভাগ আমরা নিজদেশ মিয়ানমারে ফিরতে রাজি আছি।
কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু তাহের বলেন, দিন যতই গড়াচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিরতা বাড়ছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হচ্ছে। আইন-প্রয়োগকারী সংস্থা সেখানে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও তাদের অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পে রোহিঙ্গা যারা নেতৃত্বে রয়েছে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের কোনো দুর্বলতা নেই। প্রস্তুতিরও অভাব নেই। কিন্তু প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের যে ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করার কথা কখনো মিয়ানমারের সে প্রস্তুতি ছিল না। ২০১৮ সালে সকল রোহিঙ্গার পরিবারভিত্তিক ডাটাবেজ তৈরি করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মিয়ানমারকে হস্তান্তর করি। কিন্তু ৬ বছর হতে চলল সেই ডাটাবেজের এখন পর্যন্ত যাচাই-বাছাই শেষ করেনি। গুটিকয়েক মাত্র ৫৬ হাজারের মতো সম্পন্ন করেছে।
কমিশনার মো. মিজানুর রহমান আরও বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য তারপরও আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা মিয়ানমার থেকে সাড়া পাচ্ছি যে, তারা রোহিঙ্গাদের নিজ বাড়িতে স্ব-স্ব ভিটেতে সেখানে নিয়ে যেতে নমনীয়তা প্রদর্শন করছে। মিয়ানমার বলছে, অন্তত দক্ষিণ মংডু থেকে যারা ফেরত এসেছে তাদের সেখানে ফেরত দেবে। আশা করছি, শিগগিরই হয় তো বহুল প্রত্যাশিত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারব।