বিশ্বের বৃহত্তম নদীভিত্তিক ব-দ্বীপ বেঙ্গল ডেল্টায় অবস্থানের ফলে বাংলাদেশে বন্যার প্রবণতা বেশি। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। এতে আর্থিক খরচসহ মানবসম্পদের ক্ষতির আশঙ্কাও বাড়ছে। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যায় প্রতি বছর গড়ে বাংলাদেশের স্থলভাগের ২০-২৫ শতাংশ এলাকা জলমগ্ন হয়। অন্যদিকে, চরম বন্যার কারণে দেশের ৫৫-৬০ শতাংশ এলাকা জলমগ্ন হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যার এই ঝুঁকি আরো বেড়েছে। ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যার দিক থেকে নেদারল্যান্ড ছাড়া বাংলাদেশের চেয়ে আর কোনো দেশ এগিয়ে নেই। গত বুধবার লন্ডনের গ্রান্থাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিক্সের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৪৫ মতাংশ মানুষ নদীর পানি বেড়ে সৃষ্ট বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অবস্থানগত কারণে এবং নিচু সমতল ভূমির জন্য বাংলাদেশে বন্যার প্রবণতা রয়েছে। এর মধ্যে অতিবৃষ্টির মতো জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বেশ কিছু কারণে বাংলাদেশে বন্যার ঝুঁকি আরো বাড়ছে।
গবেষকদের ধারণা, ক্রমাগত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উচ্চ নির্গমন পরিস্থিতিতে নদী প্রবাহের সর্বোচ্চ মাত্রা গড়ে ৩৬ শতাংশ বাড়তে পারে। কম-নির্গমন পরিস্থিতিতে ১৯৭১-২০০০ সালের তুলনায়। ২০৭০-২০৯৯ সালের মধ্যে সেটি ১৬ শতাংশ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সামগ্রিকভাবে ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। জলবায়ু পরিবর্তনের এই ক্ষতিকর প্রভাবের অধিকাংশই বন্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ একটি লো-এমিটিং (কম নির্গমনকারী) দেশ। ২০২১ সালে পৃথিবীতে নির্গত গ্রিন হাউজ গ্যাসের মাত্র ০.২৫ শতাংশ বাংলাদেশ থেকে নির্গত হয়েছে। তবে কৃষি এবং জ্বালানি খাত বেশিরভাগ দেশের গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমনের পেছনে দায়ী। এই দুই খাত থেকে যথাক্রমে ৪৪ শতাংশ ও ৩৯ শতাংশ গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গত হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ থেকে বন্যার ঝুঁকি সবই নির্ভর করে বৈশ্বিক নির্গমন হারের ওপর। বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশগুলোর নির্গমন এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে, বলা হয় প্রতিবেদনে।
বন্যা মোকাবিলার জন্য প্রাথমিক প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করা হয় বাঁধ নির্মাণকে। মূলত বিভিন্ন জায়গার বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোকে নিরাপদ রাখতেই এই কাঠামোগত ব্যবস্থার ওপর নজর দেওয়া হয়। কিন্তু বাঁধ নির্মাণ পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশই বন্যার ঝুঁকিতে পড়ে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে নেওয়া সরকারি নীতিমালার কারণেও বন্যার ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়েছে। বাংলাদেশে কার্যকর বন্যা ঝুঁকি প্রতিরোধী ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নের পথে বাধার হিসেবে রয়েছে দুর্বলতা এবং স্থানীয় চাহিদা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মতো স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে সক্ষমতার অভাব, প্রশাসনিক সমস্যা।
প্রতিবেদনে বন্যা প্রতিরোধের জন্য পরামর্শ হিসেবে বন্যা মোকাবিলায় কার্যকরী পদক্ষেপ এবং আরও বেশি সাংগঠনিক অংশগ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) মধ্যে আরো ভালো সমন্বয়ের মাধ্যমে বন্যা ও দুর্যোগের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে উন্নতি করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, চলতি বছরের জুনে ‘জলবায়ু ঝুঁকি নিরসন এবং জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বক্তারা জানিয়েছিলেন, ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ইনডেক্স অনুযায়ী বিশ্বের ১৯২টি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় একটি বলিষ্ঠ অভিযোজন পরিকাঠামো গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
সেমিনারে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার আহ্বান জানান বক্তারা। সেমিনারে জানানো হয়, জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা (ন্যাপ) গ্রহণ করেছে। ২০৫০ সাল নাগাদ এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩০ বিলিয়ন ডলার।
তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের অর্থনীতির যেসব খাতে প্রত্যক্ষভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তার মধ্যে কৃষি খাত অন্যতম। কারণ এর উৎপাদনশীলতা পুরোপুরি তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, তীব্রতা, আবহাওয়ার অবস্থা ও ঋতুবৈচিত্র্য ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল। ধান বাংলাদেশের প্রধান ফসল। বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ চাল উৎপাদক দেশ। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। অন্যদিকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলে বরফ গলার কারণে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষিজমির মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ফসল উৎপাদন দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। গবেষকদের মতে, কৃষিজমির লবণাক্ততা বাড়তে থাকায় কৃষি আয় বছরে ২১ শতাংশ কমে যাবে এবং উপকূলীয় অঞ্চলের ৪০ শতাংশ কৃষিজমি হুমকির মুখে পড়বে।