প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারের খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প

শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে শিখন কেন্দ্র

প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার

কক্সবাজার শহরের কাছাকাছি ইউনিয়ন খুরুশকুল। শহরের বাঁকখালী নদীর উপরেই খুরুশকুলে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য তৈরি করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক আশ্রয়ণ প্রকল্প। সেই আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ফ্ল্যাটে বাবা-মার সঙ্গে থাকে ১৩ বছরের শিশু হাসান জোহার। জেলে বাবা আর গৃহিণী মায়ের দরিদ্র পরিবার। আশপাশে নেই কোনো সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। ফলে হাসান জোহারের যে বয়সে স্কুলে যাওয়ার কথা সেই বয়স কেটেছে খেলাধুলায়। কিন্তু না ২০২১ সালের জানুয়ারিতে সেই আশ্রয়ণ কেন্দ্রে সরকার চালু করে শিখন কেন্দ্র নামের ১০টি প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে হাসান জোহার বর্তমানে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র।

শহর থেকে আধা ঘণ্টার সময় পেরিয়ে গত বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় শিখন কেন্দ্রে আলাপ হয় হাসান জোহারের সঙ্গে।

সে এখন লেখা পড়া শিখে বড় হয়ে ব্যবসা করে নিজের পিতামাতাকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তার প্রদানের স্বপ্ন দেখছে। হাসান জোহার বলেছে, বিনা মূল্যে বই, খাতা, পেন্সিল, ব্যাগ ও পোশাক পেয়েছে। উপবৃত্তির টাকা পৌঁছে যাচ্ছে পিতামাতা বিকাশ-নগদে। লেখাপড়া করছে আর পিতামাতাকেও কিছু টাকা দিতে পারছে।

শুরু হাসান জোহার নয়, ওখানে আলাপ হয়েছে চর্তুথ শ্রেণিতে পড়ুয়া তাহমিনা সিদ্দিকার সঙ্গে। একসময় মানুষের বাড়িতে কাজ, বোতল-কাগজ কুড়িয়ে তা বিক্রি করে বাবা-মাকে সহায়তা করত সেই। বলেছে, বাবা-মা গরিব, লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। এখন শিখনের শিক্ষার আলোয় সুন্দর ভবিষ্যৎ হবে।

তৃতীয় শ্রেণির জান্নাতুল ফেরদৌস জানায়, তার বাবা একটি ছোট্ট দোকান করে। দিনের বেশিভাগ সময় বাবাকে সাহায্য করে। বিকালে এসে শিখনে লেখাপড়া শিখছে। মোহাম্মদ তৌহিদ শিখন কেন্দ্রের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র। সে জানায়, আগে লেখাপড়া করলেও ২ বছর বন্ধ ছিল। বাবা-মায়ের অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে লেখাপড়া বন্ধ করে কাজ করত চায়ের দোকানে। শিখন চালু হওয়ার পর আবারও পড়ালেখা শুরু করেছে।

এইভাবে খুরুশকুল আশ্রয়ণ কেন্দ্রের ১০টি শিখন কেন্দ্রে ঝরেপড়া ও শিক্ষাবঞ্চিত ৩০০ শিশুর পাঠদান চলছে। এসব পাঠদান কেন্দ্রের শিক্ষিকা রেহেনা আকতার জানান, সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা-স্কাস নামের একটি সংস্থার অধিনে তারা চাকরি করে। এসব শিক্ষার্থীরা একটি চ্যালেঞ্জের। নানা কারণে নিয়মিতও না। ফলে পরিবারে পরিবারে গিয়ে তাদের বুঝিয়ে নিয়ে আসতে হয়। আন্তরিকভাবে পাঠদানের মধ্য দিয়ে শিক্ষাপ্রদান করা হচ্ছে।

শিক্ষিকা শাস্তা খানম ঊর্মি জানান, অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করে পাঠদানমুখি করা হয়েছে। এখন শিক্ষার্থীরা অনেকটা নিয়মিত। আশ্রয়ণ কেন্দ্রের গোলাপ ভবনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সুলতান জানিয়েছেন, কক্সবাজার পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল এলাকায় দীর্ঘদিন বসবাস করতেন এসব উদ্বাস্তু মানুষ। কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের উন্নয়নের প্রয়োজনে এসব মানুষকে উচ্ছেদ করার প্রয়োজন হলেই প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তৈরি করা হয় এই আশ্রয়ণ কেন্দ্র। ২০২০ সালের ২৩ জুলাই প্রধানমন্ত্রী এটি উদ্বোধনের পর যেখানে পরিপাটি দালানের ফ্ল্যাটে আশ্রয় নিয়েছে ৪ হাজারের বেশি উদ্বাস্তু পরিবার। পেশায় শ্রম বা জেলে এসব পরিবারের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা যেনতেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আশপাশে নেই কোনো প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠান রয়েছে তা আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে কমপক্ষে ৫ কিলোমিটার দূরে। ফলে আগে যারা স্কুল যেতেন, অনেকটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এসব শিশু সন্তানদের লেখাপড়া। আর যারা আগে থেকে অর্থনৈতিক প্রয়োজনে পরিবারকে সহায়তা করতে তারা তো এমনিতে শিক্ষা বঞ্চিত ছিল। শিখন কেন্দ্র চালু হওয়ার পর অনেক শিশু লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। সরকারের এই উদ্যোগকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

কোরাল ভবনের ৫০৪ নম্বর ফ্ল্যাটের বসবাসরত কুলসুমা নামের এক নারী জানান, নতুন ফ্ল্যাটে আসার পর স্কুল দূরে হওয়ায় তার ২ শিশুকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। এখন শিখনে পড়াচ্ছে। কিন্তু শিখন কেন্দ্রে বেঞ্চ নেই। মেঝেতে বসা পড়ালেখা শিশুদের ভোগান্তি হয়। এটা একটু উন্নত করার দাবি জানান তিনি।

দোলন চাঁদা ভবনের সভাপতি শাহাব উদ্দিন জানান, দরিদ্র পরিবারের শিশুরা স্কুলে না গিয়ে যাযাবর হয়ে উঠেছিল। শিখন তাদের স্বপ্ন তৈরিতে সহায়তা করছে।

সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা- স্কাস-এর চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা জানান, সরকারের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আউট অব স্কুল এডুকেশন প্রোগ্রাম (পিইডি-৪) প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজারের ৩১০টি শিখন কেন্দ্র পরিচালনা করেন তার সংস্থা। এর মধ্যে খুরুশকুল আশ্রয়ণ কেন্দ্রের ১০টি কেন্দ্র অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য কেন্দ্রগুলোতেও সুবিধা বঞ্চিত শিশুরা পড়ে। সব বিবেচনায় শিশুদের শিক্ষার স্রোতে নিয়ে আসতে আন্তরিকভাবে কাজ করছেন তিনি।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিনে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আউট অব স্কুল এডুকেশন প্রোগ্রাম (পিইডি-৪) প্রকল্পের আওতায় এসব শিখন কেন্দ্র বলে জানিয়েছেন, কক্সবাজার জেলায় দায়িত্বরত উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহকারী পরিচালক একেএম বজলুর রশীদ তালুকদার।

তিনি জানিয়েছেন, কক্সবাজার পৌরসভাসহ ৩ উপজেলায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে কক্সবাজার পৌরসভায় ১০০টি কেন্দ্র, সদর, রামু ও চকরিয়ায় উপজেলায় ৭০টি করে মোট ২১০টি কেন্দ্র রয়েছে। যেখানে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২ হাজার ৩০০ জন। প্রকল্পটি মূলত ঝরেপড়া শিক্ষার্থী বা যারা কখনও স্কুলে যায়নি, তাদের টার্গেট করে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারের এই উদ্যোগ।

তিনি জানান, এসব শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক পাঠ্যবইয়ের সিলিবাস আধুনিক করে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। ১ বছরের স্থানে ৬ মাসের সিলিবাসে পাঠদান করা হয়। শিক্ষার্থীদের দ্রুত সময়ের মধ্যে শিক্ষার মূল স্রোতে ফিরাতে এই কার্যক্রম। এটি সরকারের উদ্যোগ হলেও মূলত বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কক্সবাজারে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা-স্কাস।

একেএম বজলুর রশীদ তালুকদার জানান, কক্সবাজারের ১২ হাজার ৩০০ শিশুকে শনাক্ত করার পর বর্তমানে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান শেষ করেছে। এসব শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ যেমন রয়েছে, তেমনি কারিগরি দক্ষতা বাড়িয়ে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সরকারে পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি জানান, মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে এরই মধ্যে ৩ শত জনকে প্রাথমিককে ভর্তি করে মূল স্রোতে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অন্য শিক্ষার্থীরা ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান শেষে পরীক্ষা গ্রহণ করে মূল স্রোতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে স্বাক্ষরতার হার ৮০ শতাংশে পৌঁছে যাবে।