সুষম উন্নয়নে সমৃদ্ধির পথে পাহাড়ি জনপদ খাগড়াছড়ি
জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন
প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রাহাত হুসাইন, খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে
পাহাড়-ঝরনা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত নয়নাভিরাম জেলা খাগড়াছড়ি। পর্যটনবান্ধব এ জেলার পরতে পরতে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। সরকারের সুষম উন্নয়নে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের অন্যতম পাহাড়ি এ জনপদ। অবকাঠামোগত উন্নয়নে গেল ১৫ বছরে এ জেলার মানুষের জীবনযাত্রায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ধারাবাহিক উন্নয়নে খাগড়াছড়ি জেলায় আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পর্যটন ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগন্তকারী ছোঁয়া লেগেছে।
পাহাড়ি জনপদে পরিবর্তনের আরেক আশীর্বাদ বিদ্যুৎ। প্রত্যন্ত এলাকার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌছে দিয়েছে সরকার। খাগড়াছড়ির ভূমিহীনদের জন্যও দৃষ্টিনন্দন আবাসন নির্মাণ করেছে সরকার। উদ্ধোধনের অপেক্ষায় রয়েছে রামগড় স্থালবন্দর। নির্মাণ হচ্ছে সিমান্ত সড়ক, যা পার্বত্য অঞ্চলকে যুক্ত করবে এশিয়ান হাইওয়ে। সরেজমিন দেখা গেছে, সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির ফলে জেলার ৯টি উপজেলার মানুষের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। পাহাড় বেয়ে কষ্ট করে বাজার-হাটে যেতে হচ্ছে না পাহাড়ি ও বাঙালিদের। খাগড়াছড়ির সিন্দুকছড়িতে উচু-নিচু পাহাড়ের কোলঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে পিছঢালা সড়ক। এ সড়ক স্থানীয়দের জন্য আর্শিবাদ হয়ে উঠেছে। সিন্দুকছড়িতে নির্মিত সড়ক চতুর্মুখী যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। খাগড়াছড়ির গুইমারা, লক্ষ্মীছড়ি ও মহালছড়ি উপজেলার বাসিন্দারা এ সড়কটি ব্যবহার করছে। সিন্দুকছড়ি সড়ক নির্মাণ হওয়ার আগে দুর্গম এলাকায় ছিল। একসময় এই রাস্তা দিয়ে দিন-দুপুরে হেঁটে যেতেও মানুষ ভয় পেত। রাস্তার দুই পাশে ভয়ংকর জঙ্গল ছিল। পাহাড় বেয়ে কষ্ট করে যাতায়াত করত। বৃষ্টি হলে তো হাঁটাই যেত না। কাদা-পানিতে তলিয়ে যেত। এখন মানুষ গাড়িতে চড়ে বাজার হাটে যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়ায় দুর্ভোগ কমেছে শিক্ষার্থীদের। পাহাড়ের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সহজে পৌঁছে যাচ্ছে দেশ-বিদেশে। এতে বেড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য।
স্থানীয় বাসিন্দা দীপন চাকমা বলেন, সিন্দুকছড়ি একসময় দুর্গম এলাকা ছিল। মানুষজন সহজে বাজার ঘাটে যেতে পারত না। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে, দুগর্ম এই পথকে চিহ্নিত করে উন্নয়নের আওতায় নিয়ে আসে। পিছঢালা সড়ক হওয়ার ফলে এখানে উৎপাদিত কৃষিপণ্য খুব সহজেই দেশের সব জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে। এই সড়ক দিয়েই রাঙামাটি, বান্দরবন, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে। এই সড়ক নির্মাণের ফলে চতুর্মুখী যাতায়াতের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
দুর্গম এলকায় সোলার বিদ্যুৎ : খাগড়াছড়ির ওই সব এলাকায় জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ পৌঁছানো দুরূহ, সেসব দুর্গম এলাকা সরকারি সহায়তায় বসানো হয়েছে সোলার প্যানেল। বিদ্যুৎ পেয়ে প্রত্যেক মানুষ উচ্ছ্বসিত পাহাড়ের বাসিন্দারা। বিনামূল্যে ১০০ মেগাওয়াট সোলার প্যানেল পেয়ে খুশি উপকারভোগীরা। সন্ধ্যার পর পার্বত্য অঞ্চল এখন আর আগের মতো আঁধারে সুনসান নীরব হয় না। বিদ্যুতের আলোয় পড়াশোনা করে উজ্জ্বল ভবিষৎ গড়ছে তাদের সন্তানরা। খাগড়াছড়ি জেলায় ১৩ হাজার পরিবারকে সোলার হোম সিস্টেম বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া খাগড়াছড়ি জেলায় ৮০০ প্রতিষ্ঠানকে সোলার কমিউনিটি সিস্টেম বিতরণের জন্য বিভাজন করা হয়েছে। সোলার প্যানেল সঠিকভাবে পরিচালনা ও ব্যবহার পদ্ধতি আয়ত্তে রাখার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী প্রত্যেক পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে ৬৫০ টাকা ভাতা প্রদান করা হচ্ছে।
ভূমিহীনদের জন্য দৃষ্টিনন্দন আবাসন : খাগড়াছড়ির সদরে ভূমিহীনদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন আবাসন। ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব আবাসন প্রকল্প’র আওতায় ৭ একর জমির ওপর দুই তলাবিশিষ্ট ১৫টি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পে ভূমিহীন ৬০টি পরিবারে আশ্রয় পাবে। এ প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ি পৌরসভার মেয়র নির্মলেন্দু বলেন, ৭ একর জায়গার ওপর পৌরসভার অর্থায়নে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে ১৫টি ভবনে ৬০টি পরিবার থাকতে পারেব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন।
রামগড় স্থলবন্দর : খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়ে ফনী নদীর উপর নির্মাণ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১’। এই সেতু দিয়ে মাত্র ৩ ঘণ্টা ভারত থেকে পণ্য আসবে বাংলাদেশে। এজন্য প্রস্তুত রামগড় স্থলবন্দরও। চট্টগ্রাম থেকে পণ্যবাহী গাড়ি বারৈয়ারহাট থেকে রামগড় স্থলবন্দর হয়ে ভারতে যাবে। একইভাবে রামগড় স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় পণ্য আসবে চট্টগ্রাম বন্দরে।
এখন শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষা। রামগড় স্থলবন্দরকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দা কাউসার হাবিব শোভন। তিনি বলেন, রামগড় স্থলবন্দর কেন্দ্র করে আমাদের এই এলাকার রাস্তাঘাট, কালভার্ট, ব্রিজসহ স্থানীয়দের ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া সাংস্কৃতিক ও পর্যটন খাত আরো সমৃদ্ধ হবে।
খাগড়াছড়ি জেলায় উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী বলেন, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর খাগড়াছড়ি জেলায় রাস্তাঘাট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শত সেতু উদ্ধোধন করেছেন, তার মধ্যে ৪২টি সেতু ছিল খাগড়াছড়ি জেলার। বিএনপির আমলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র ২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত।
এখন ২৪ ঘণ্টাই আমরা বিদ্যুৎ পাই। যেখানে আগামী ২০ বছরেও বিদু্যুৎ পৌঁছানো যাবে না। সেখানে সোলারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছেন প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিন পাবর্ত জেলায় ৫২ হাজার পরিবারকে বিদ্যুতের আওতায় নিয়ে এসেছে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হওয়ার কারণে হাজার-হাজার পর্যটক আসছে। দিন দিন খাগড়াছড়িতে কর্মসংস্থান বাড়ছে। বিদ্যুৎব্যবস্থা উন্নয়নের ফলে বিসিক নগরীতে অনেক উদ্যোক্তা বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে পেরেছে। মিনারেল ফ্যাক্টরি ছাড়াও আরো অনেক প্রকল্প চলমান আছে। এই জেলায় প্রায় ২৫০টি স্কুলকে সরকারিকরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রত্যেক এ জেলার উপজেলায় একটি করে কলেজও সরকারিকরণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে এই জেলার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।
জানতে চাইলে খাগড়াছড়ি জোলা প্রশাসক মো.সহিদুজ্জামান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে আমরা এখন স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সেই ধারাবাহিকতায় খাগড়াছড়ি জেলাও পিছিয়ে নেই। গত ১৫ বছরে খাগড়াছড়িতে ব্যাপক উন্নয়ন সংগঠিত হয়েছে।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, মৎস্য, সড়ক সবক্ষেত্রেই এ জেলার প্রভুত উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে খাগড়াছড়িতে সড়ক উন্নয়নে বেশ এগিয়েছে। এ জেলায় প্রায় ৫৯টি ব্রীজ হয়েছে, এবং ১০৯ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করা হয়েছে। এ জেলার বিভিন্ন সড়কের উন্নয়নের ফলে, খাগড়াছাড়িতে উৎপাদিত বনজ ও ফলজ পণ্য দ্রুতই ঢাকাসহ সারাদেশে সরবরাহ করতে পারছি। এ কারণে প্রান্তিক চাষিরা ন্যায্যমূল পাচ্ছেন।
এছাড়া রামগড় স্থলবন্দর নির্মাণ করা হয়েছে। এটা উদ্বোধন হলে ভারত-বাংলাদেশের ব্যাপক বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। স্থানীয়দের জীবনমান উন্নয়ন হবে। পর্যটন শিল্পেও খাগড়াছড়ি জেলায় উন্নয়ন হয়েছে। আলুটিলায় পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ হওয়ায় সেখানে দিন দিন পর্যটক বাড়ছে। অনাবাধি জমি চাষাবাদের আওতায় আনা হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রেও আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে। পাশাপশি খাগড়াছড়ি জেলা সদরে অসহায়, ভূমিহীন, গৃহহীন, ভাসমান লোকদের জন্য দৃষ্টিনন্দন আবাসন ভবন তৈরি করা হয়েছে।