আনন্দঘন পরিবেশে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে দেশের তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্রের উদ্বোধন করা হয়েছে। গতকাল বেলা সোয়া ১১টায় পঞ্চগড় সরকারি অডিটরিয়াম চত্বরে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে নিলাম কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও রেলপথমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজন।
অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি চা চাষিদের নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, নিলাম কেন্দ্র চালু হলো কিন্তু চাষিরা যদি ভালো দাম না পান তাহলে এটি হবে মূল্যহীন। চাষিরা ঘাম ঝরিয়ে চা উৎপাদন করছেন। কিন্তু বিক্রি করতে গেলে উপযুক্ত দাম পান না। আমরা আশা করছি, এই নিলাম কেন্দ্রের মাধ্যমে আগের অবস্থা থেকে চা চাষিরা মুক্তি পাবেন। চাষিরা আর কারো হাতের পুতুল হয়ে থাকবেন না। কারো ইচ্ছার ওপর যেন তাদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে না হয়। নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে কৃষক-শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। উৎপাদিত চা পাতার ন্যায্যমূল্য দিতে পারলেই চা নিলাম কেন্দ্রের স্বার্থকতা মিলবে। ‘ছাওয়া না কান্দিলে মাও দুধ দেয় না’ উল্লেখ করে টিপু মুনশি বলেন, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমরা নিলাম কেন্দ্র চালু করলাম, এখন ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। চা বোর্ড, ফ্যাক্টরি মালিক, চা চাষিসহ সংশ্লিষ্টদের এজন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। চা পাতার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে হবে। কিন্তু কোনো সিন্ডিকেট করতে দেয়া হবে না।
এ সময় তিনি চা চাষি ও সংশ্লিষ্টদের সঠিক প্রক্রিয়ায় চা পাতা কাটা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের তাগিদ দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, দেশে এখন পঞ্চগড়ের চায়ের একটি অবস্থান তৈরি হয়েছে। এখানে ভালো মানের চা পাতা উৎপাদন করা গেলে দেশের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানির সুযোগ কাজে লাগানো যাবে। পঞ্চগড়ের চা নিলাম কেন্দ্র দেশের প্রথম অনলাইন নিলাম কেন্দ্র। ভালো ফল পেতে হলে আমাদের একটু ধৈর্য ধারণ করতে হবে। টিপু মুনশি বলেন, চা নিলামের সময় সশরীরে যারা অংশ নেবেন তারা এখানে আসবেন। আমরা চাই বিদেশিরাও এখানে আসুক, নিলামে অংশ নিক। এজন্য যোগাযোগ ও আবাসন ব্যবস্থা আরো উন্নত করতে হবে। আমরা ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দরটি চালুর ব্যাপারেও ভাবছি। যদি তাদের ভালো মানের একটা পরিবেশ দেয়া না যায়, তাহলে নিলাম কেন্দ্রের সুফল পাওয়া যাবে না। বাণিজ্যমন্ত্রী আরো জানান, দেশের চা উৎপাদনের ৬৫ শতাংশ উৎপাদন হয় সিলেট অঞ্চলে। সেখানে চা নিলাম কেন্দ্র হতে ১০০ বছরের বেশি সময় লেগেছে। কিন্তু এখানে মাত্র ২০ বছরের মধ্যে নিলাম কেন্দ্র করা সম্ভব হলো। এটা সত্যিই গৌরব ও সৌভাগ্যের। এখন চায়ের গুণগত মান ঠিক রাখতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে চা পাতা উত্তোলনের জন্য কৃষকদের বিনামূল্যে যন্ত্রপাতি সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। চা শিল্পের উন্নয়নে এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টদের সবাইকে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে এবং এটি অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশ চা বোর্ড এবং স্মল টি গার্ডেন ওনার্স অ্যান্ড টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন রেলপথ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. নূরুল ইসলাম সুজন, পঞ্চগড় -১ আসনের সংসদ সদস্য মো. মজহারুল হক প্রধান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ, বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম, রংপুর বিভাগীয় কমিশনার হাবিবুর রহমান, পঞ্চগড়ের সাবেক জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ রবিউল ইসলাম। সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম।
স্বাগত বক্তব্য দেন স্মল টি গার্ডেন ওনার্স অ্যান্ড টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ পঞ্চগড়ের সভাপতি আমিরুল হক খোকন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জেলা পুলিশ সুপার এসএম সিরাজুল হুদা, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আব্দুল হান্নান শেখ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ার সাদাত সম্রাট। এর আগে বেলা সোয়া ১১টায় আনন্দঘন পরিবেশে পঞ্চগড় সরকারি অডিটরিয়াম চত্বরে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে নিলাম কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও রেলপথ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. নূরুল ইসলাম সুজন। পরে বাণিজ্যমন্ত্রী উদ্বোধন স্থলে স্থাপিত বিভিন্ন টি স্টল পরিদর্শন করেন।
দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে সমতলে চা চাষ করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এগিয়ে থাকা পঞ্চগড়বাসী নতুন এই নিলাম কেন্দ্র পেয়ে আনন্দিত। তারা ‘সমতলে চায়ের ভুবন- পঞ্চগড়ে স্বাগতম’ স্লোগানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে অতিথিদের স্বাগত জানান।
২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর পঞ্চগড়ে দেশের তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ সরকার। অবশেষে সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত চা নিলাম কেন্দ্র চালু হওয়াতে আশার আলো দেখছেন উত্তরাঞ্চলের সমতলের চা চাষিরা। চা নিলাম কেন্দ্র চালু হওয়ায় চাষিরা তাদের উৎপাদিত চা পাতার ন্যায্যমূল্য পাবেন বলে স্বপ্ন দেখছেন। দীর্ঘদিন ধরে সিন্ডিকেটের জাঁতাকলে তারা চা পাতার দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ করে আসছেন। দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে এ অঞ্চলে চা নিলাম কেন্দ্র চালুর দাবি জানিয়ে আসছিলেন চা সংশ্লিষ্টরা।
চায়ের নিলাম কেন্দ্র ঘিরে চা শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা কাজ করছে। গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ব্রোকার ও ওয়্যার হাউজ। এরই মধ্যে ১০টি ব্রোকার হাউজের মধ্যে পাঁচটিকে এবং আটটি ওয়্যার হাউজের মধ্যে দুটিকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। অনলাইন অ্যাপস তৈরিসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে।
চা সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের এই তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্রর চালুর মধ্যদিয়ে উত্তরাঞ্চলের চা শিল্পের আরো উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনীতি সমৃদ্ধি ঘটবে। দীর্ঘদিন ধরে সমতলের চা চাষিদের মধ্যে তাদের উৎপাদিত চা পাতার দাম না পাওয়ায় যে হতাশা তৈরি হয়েছে, তা নিরসন ঘটবে। পাশাপাশি চায়ের পরিবহণ খরচ কমে যাবে। সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান। ক্ষুদ্র চা চাষিরা নিলাম কেন্দ্রে চায়ের উন্মুক্ত কেনাবেচায় চায়ের কাঁচা পাতার ন্যায্যমূল্যও পাবেন। এতে গোটা উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন হবে বলে মনে করছেন তারা।
পঞ্চগড় জেলার ২৪টি কারখানায় চলতি অর্থবছরে (২০২৩ ও ২০২৪) ২ কোটি কেজি চা উৎপাদনের আশা করছে চা বোর্ড। তবে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ৮০ লাখ ২৮ হাজার ৮৫০ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে।
চাষিরা বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরেই পঞ্চগড়ে চায়ের নিলাম বাজার চালুকরণের লক্ষ্যে দাবি জানিয়ে আসছি। কারণ, আমরা একটি সিন্ডিকেটের কারণে চা পাতার উপযুক্ত দাম পাচ্ছি না। নিলাম বাজারে চা কারখানা মালিকরা যেন উন্নতমানের চা তোলে। কেন না, কারখানায় উৎপাদিত উন্নতমানের চা কর ফাঁকি দিয়ে বিক্রি করে নিম্নমানের চা নিলামে তোলায় চাষিরা প্রকৃত দর পাওয়া থেকে এতদিন বঞ্চিত ছিলেন। আশা করছি এ নিলাম কেন্দ্র চালুর মধ্যদিয়ে আমরা আমাদের উৎপাদিত চা পাতার ন্যায্য দাম পাব।