কক্সবাজার শহরের একটি অনুষ্ঠানে পার্টি গার্ল বা নৃত্যশিল্পী হিসেবে ঢাকা থেকে কক্সবাজার এসেছিল তিন কিশোরীসহ পাঁচজন। ৩ সেপ্টেম্বর সকালে কক্সবাজার পৌঁছার পর উঠে ছিল কলাতলীর একটি আবাসিক হোটেলে। যে প্রতিষ্ঠানটি থেকে সোমবার রাত ১১টায় দুই বান্ধবী বের হয়ে হেঁটে গিয়ে সুগন্ধা সড়কের পাশে নাস্তা করতে যায়। সেখান থেকে হোটেলে ফেরার সময় একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাযোগে পাঁচ যুবক এসে তাদের গতিরোধ করে। তারা দুইজনকে হাত, মুখ চেপে অস্ত্রের মুখে জোরপূর্বক অটোরিকশাযোগে নিয়ে যায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের বিপরীতে কটেজ জোনের রাজন কটেজে।
কক্সবাজারের কটেজ জোনে তরুণী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকারের পর পুলিশের কাছে দায়ের করা মামলার এজাহারে এমন বর্ণনা দেয়া হয়েছে। দুইজনের মধ্যে একজন বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর থানার দায়ের করা এজাহারটি নিয়মিত মামলা হিসেবে লিপিবদ্ধও করেছে পুলিশ, যে এজাহারের একটি কপি প্রতিবেদকের হাতে এসে পৌঁছেছে।
ওই কিশোরী এজাহারের বিবরণে বলেছে- রাজন কটেজে প্রবেশের পরই দুই কিশোরীকে পৃথক কক্ষে বন্দি করা হয়। অপর কক্ষের পরিস্থিতি সে অবহিত না হলেও তার উপরে চালানো হয় ভয়াবহ নির্যাতন। তারপর রাতভর পালাক্রমে ধর্ষণের শিকার হয়, যার ফলে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। গত মঙ্গলবার সকালে জ্ঞান ফেরার পর দুইজনকে হুমকি দিয়ে ইজিবাইক (টমটম) যোগে নিয়ে যাওয়া হয় বাস টার্মিনাল এলাকায়। ওখানে মারসা নামের একটি বাসে তাদের দুজনকে তুলে দেয়া হয়। কিন্তু দুজনের একজনের রক্তরক্ষণসহ অসুস্থবোধের কারণে বাস থেকে নেমে গিয়েছিল রামু বাইপাস এলাকায়। যেখান থেকে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল রামু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
এর সূত্র ধরেই গত মঙ্গলবার দিনভর নানা আলোচনার পর রাত ৯টায় পুলিশ কক্সবাজার শহরের কলাতলীস্থ কটেজ জোনে দুই তরুণী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকারের ঘটনা স্বীকার করে। জড়িতদের একজনকে আটকের কথা স্বীকার করেছিল পুলিশ।
রামু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এই কিশোরীর চিকিৎসা প্রদান করেছিলেন কর্তব্যরত চিকিৎসক নুরুল হুদা শাওন। গতকাল দুপুরে ডাক্তার নুরুল হুদা শাওন জানান, যে তরুণী মঙ্গলবার সকালে চিকিৎসার জন্য যায় তার মাথা ফাটা এবং রক্তাক্ত ছিল। একই সঙ্গে যৌন নির্যাতনের বিষয়টি ছিল। যার কারণে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হলে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়ার কথা স্বীকার করে পুলিশি সহযোগিতা চেয়েছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে রামু থানার পুলিশকে তিনি অবহিত করেন এবং কিশোরীকে পুলিশি হেফাজতে হস্তান্তর করেন।
গত মঙ্গলবার এ ঘটনার পরপরই কক্সবাজার সদর থানার পুলিশ ঘটনাস্থল রাজন কটেজে গিয়েছিলেন বলেন স্বীকার করেছেন রাজন কটেজের সহকারী ব্যবস্থাপক নুরুল আজিম। তিনি বলেন, গত সোমবার রাতে কটেজের দায়িত্বরত ছিলেন আরেক সহকারী ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সোহেল। গত মঙ্গলবার সকাল ৯টায় তিনি হোটেলে দায়িত্ব পালন করতে আসেন। এ সময় তিনি ঘটনার ব্যাপারে কিছুই জানেননি। পরে বিকাল ৫টার দিকে পুলিশের একটি দল কটেজে এসে সোহেলকে আটক করে নিয়ে যায়। এ সময় ঘটনার ব্যাপারে আমি অবহিত হই।
তিনি বলেন, পুলিশ কটেজ থেকে অতিথি নিবন্ধন খাতা, সিসিটিভি ফুটেজ এবং ঘটনাস্থল হিসেবে চিহ্নিত ১১২ নম্বর কক্ষ থেকে কিছু আলামত সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। তবে ঘটনা কারা, কীভাবে সংঘটিত করেছে; সেই ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানান কটেজটির এ সহকারী ব্যবস্থাপক।
গতকাল বিকাল ৪টার দিকে কক্সবাজার সদর থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ভিকটিমকে সাথে নিয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসিটিভির ফুটেজ দেখে তিনজনকে শনাক্ত করেছে, যার মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। এ ঘটনায় ভিকটিম বাদী হয়ে তিনজনের নাম উল্লেখ করে দুইজনকে অজ্ঞাত আসামি করে এজাহার দায়ের করলে মামলাটি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। মামলাটি ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারকে তদন্তের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।
এ ঘটনায় গ্রেপ্তার এজাহারের ১ নম্বর আসামি সোলেমান শামীম (২৩) কক্সবাজার শহরের মোহাজের পাড়ার বাসিন্দা সাইফুল ইসলামের ছেলে। এজাহারে উল্লেখ অপর দুইজন হলো হারবদল ও রশিদ ড্রাইভার।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী পুলিশ শেহেরিন আলম বলেন, গতকাল সকালে ভুক্তভোগী তরুণী বাদী হয়ে তিনজনের নাম উল্লেখসহ পাঁচজনকে আসামি করে কক্সবাজার সদর থানায় মামলা করেন। মামলাটির তদন্তভার দেয়া হয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশের এক কর্মকর্তাকে।
ঘটনার পর অভিযান চালিয়ে কক্সবাজার সদর থানা পুলিশ সোলেমান শামীম (২৩) নামের এজাহারভুক্ত এক আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে জানিয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশের এ সহকারী পুলিশ সুপার বলেন, মামলার এজাহারে নাম উল্লেখ করা দুই আসামিসহ অজ্ঞাতনামা আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
ভিকটিম এজাহারে সাথে আরো তিনজন এবং ঢাকায় অপর বান্ধবী চলে যাওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও তাদের সাথে আলাপ হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে সহকারী পুলিশ শেহেরিন আলম বলেন, ‘এদের সাথে আলাপের জন্য ভিকটিমের সাথে আলোচনা হচ্ছে। তিনি জানান, এ অপরাধের ক্ষেত্রে রাজন কটেজ কর্তৃপক্ষ জড়িত কি না, আইন মেনে কক্ষ ভাড়া দেয়া হয়েছে কি না, তা নিয়ে তদন্ত চলছে।