ট্রলার থেকে ১০ মরদেহ উদ্ধার

আত্মস্বীকৃত দস্যু সুমন মিয়ার ক্লিন মিশনেই হত্যা!

প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার

কক্সবাজারের নাজিরারটেক উপকূলে ট্রলার থেকে ১০ মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় বহুল আলোচিত আত্মস্বীকৃত দস্যু সর্দার খাইরুল বশর ওরফে সুমন মিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে কক্সবাজার সদর মডেল থানা পুলিশ। গত বুধবার রাতে চট্টগ্রামের ইপিজেড রেলগেইট এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল বিকালে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. মিজানুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, সংঘঠিত ঘটনার পর ‘আত্মস্বীকৃত দস্যূ সর্দার খাইরুল বশর ওরফে সুমন মিয়ার ক্লিন মিশনে ১০ জেলে হত্যার বিষয়টি উঠে আসে। এরপর থেকে পুলিশি ঝামেলা এড়াতে সুমন মিয়া আত্মগোপনে চলে যান। এমনকি দাঁড়ি রেখে তার আসল খোলস পাল্টান। ছদ্মবেশে চট্টগ্রামে আত্মগোপন করেন। সম্প্রতি নানাভাবে তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয় পুলিশ। তার আলোকে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে একটি টিম চট্টগ্রামে অবস্থান নেয় এবং বুধবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদিকে গ্রেপ্তার সুমন মিয়াকে গতকাল বিকাল ৫টার দিকে কক্সবাজার সদর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হলে বিচারক শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গাঁ তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কক্সবাজার সদর মডেল থানার পরিদর্শক (গোয়েন্দা) দুর্জয় বিশ্বাস এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে হাজির করা হলে আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আদালত থেকে সুমনকে রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কক্সবাজার সদর মডেল থানার পরিদর্শক (গোয়েন্দা) দুর্জয় বিশ্বাস বলেন, ‘সাগরে ঘটে যাওয়া হামলার ঘটনায় ২৫ জনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। তদন্তে উঠে আসা নামগুলো যাছাই করা হচ্ছে, যাদের সংশ্লিষ্টতা মিলবে তারাই আইনের আওতায় আসবে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টদের দাবি, গত ৯ এপ্রিল একটি গ্রুপ সাগরে সংঘবদ্ধ ডাকাতির সংঘটিত করে। এতে দুই পক্ষের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ডাকাতি করতে যাওয়া গ্রুপটির গুলি শেষ হয়ে গেলে এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ জেলেরা দুটি ট্রলার নিয়ে জড়ো হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেন। ১২ থেকে ১৩ জনের ওই গ্রুপটিকে পিটিয়ে হত্যার পর হাত-পা বেঁধে তাদের ট্রলারটি ডুবিয়ে দেয়।

পুলিশের ভাষ্য মতে, আত্মস্বীকৃত দস্যু সুমন মিয়া ১২ থেকে ১৩ জনের ওই গ্রুপকে সাগরে পাঠানোর নাটের গুরু।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তিগত তদন্ত, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে অনেক তথ্য আমরা পেয়েছি। পুরো গ্রুপকে শনাক্ত করেছি। তদন্তও শেষ পর্যায়ে। অচিরেই চার্জশিট দেয়া হবে।

পুলিশের তথ্য মতে, এই হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, যার মধ্যে ছয়জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবাবন্দি দিয়েছেন।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মামলার প্রধান আসামি বাইট্টা কামাল, বাঁশখালীর বাসিন্দা ফজল কাদের মাঝি ও আবু তৈয়ুব মাঝি, মহেশখালী পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর খায়ের হোসেন, চকরিয়ার বদরখালী এলাকার মো. নুর নবীর ছেলে গিয়াস উদ্দিন মুনির, মাতারবাড়ী ইউনিয়নের সাইরার ডেইল এলাকার এস্তেফাজুল হকের ছেলে দেলোয়ার হোসেন।

এর মধ্যে মামলার ৪ নম্বর আসামি করিম সিকদার ও বাইট্টা কামালের ভাই ইমাম হোসেন জবানবন্দি প্রদান করেননি।

কে এই নাটের গুরু সুমন?

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, এককালে কক্সবাজার সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুতার নিয়ন্ত্রণ করতেন মহেশখালীর সোনাদিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত জলদস্যু আবদুল গফুর প্রকাশ নাগু মেম্বার।

বিরোধের জের ধরে ২০১৬ সালের ৪ জুলাই নাগুকে হত্যা করেন তার ভাই বাহাদুরের ছেলে সরওয়ার প্রকাশ বতৈল্যার নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী। নাগুর মৃত্যুর পর সেখানে প্রভাব বাড়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত আরেক শীর্ষ দস্যু মোকাররম হোসেন জাম্বুর। একের এক পর ডাকাতি করে সাগরে রামরাজত্ব চলায় জাম্বু।

তবে ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর জাম্বু র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। এ ঘটনায় ৪৪টি অস্ত্র ও ১ হাজার ২১৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে র‌্যাব।

জাম্বু অধ্যায়ের পর বাহিনীটির নিয়ন্ত্রণ নেন তার সহযোগী আনজু মিয়া। আনজু ছিলেন নাগুর ভাগ্নে। আর আনজুর মামাতো ভাই সুমন মিয়া। সুমন ছিলেন আনজুর বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড। এই দস্যু গ্রুপটি সোনাদিয়া সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরকে অনিরাপদ করে জেলেদের মূর্তিমান আতঙ্ক ছিল। তবে বছরখানেক পর এই বাহিনীর প্রধান আনজু ও সেকেন্ড ইন কমান্ড সুমনসহ ৯ সদস্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর বছর দেড়েক কারাভোগ শেষে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন কয়েকজন।

জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, অন্যান্যরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেও সুমন ছিল ব্যতিক্রম। চিংড়ি ঘের ও কাঁকড়া চাষের আড়ালে পুনরায় অপরাধ জগতে পা বাড়ান তিনি।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, সুমন মিয়া সোনাদিয়া দ্বীপের পূর্ব পাড়ার মৃত মোস্তফার ছেলে। বিয়ে করেছেন বদরখালী থেকে। সেই সুবাদে শাপলাপুর আর চকরিয়ার কোনাখালীসহ উপকূলীয় অঞ্চলের অপরাধীদের সাথে তার সখ্যতা ছিল। উল্লেখ, গত ২৩ এপ্রিল নাজিরারটেক পয়েন্ট থেকে ভাসমান ট্রলারের ভেতর থেকে ১০ জনের লাশ উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরের দিন শনাক্ত হওয়া ছয়জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। বাকি চার মরদেহের পরিচয় নিশ্চিত হতে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। একই সঙ্গে নিখোঁজ থাকা ব্যক্তিদের স্বজনদের ডিএনএ নমুনাও সংগ্রহ করা হয়। গত ৯ জুলাই ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়ার পর তিনজনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফলে মরদেহ চারটি এদের কারো ছিল না। এখনো চারজন নিখোঁজ।

তদন্ত কর্মকর্তা দুর্জয় বিশ্বাস বলেন, ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল হাতে আসার পর এখন নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, ট্রলারটিতে ঘটনার দিন মোট ১৩ জন ছিলেন। এ ঘটনার দুই দিন পর সোনাদিয়ায় একটি কঙ্কাল ভেসে আসে। আমরা ধারণা করছি, ওই কঙ্কালটি ট্রলারে থাকা কোনো ব্যক্তির।