এক সময় চালের বাজার অস্থির ছিল। সে সময় বলা হতো বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান। কিন্তু আলুর সেই দিন আর নেই। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল ও আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে। গরিবের জন্য সেই আলুও এখন বিলাসী পণ্য। এক কেজি আলু উৎপাদনে সাড়ে ১০ টাকা খরচ করে কৃষক বিক্রি করেছেন ১৪ থেকে ১৫ টাকায়। এক হাত বদল হয়ে হিমাগারে সংরক্ষণ খরচসহ প্রতি কেজির দাম পড়ছে ২০ টাকা। চলতি বছর মে মাস থেকে বাড়তে থাকা আলুর কেজি এখন ৫০ টাকা। সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের বাজারব্যবস্থা। বলা যায়, কোনো নিত্যপণ্যের ব্যবসাই এখন আর সিন্ডিকেটমুক্ত নেই। আলুর বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে গত কয়েক মাস ধরেই। বোঝা যাচ্ছিল এ ক্ষেত্রেও কারসাজি আছে। দীর্ঘদিন ধরেই নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছিল, দেশের বাজার চলে গেছে সিন্ডিকেটের হাতে। এই সিন্ডিকেটই তাদের মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অবস্থা বুঝে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে চলেছে। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ভেঙে দিতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। বর্তমান সরকার প্রথমবারের মতো বেঁধে দিলো- ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দাম। বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রথমবারের মতো এই তিনটি কৃষিপণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার। বেঁধে দেওয়া দাম অনুযায়ী, এখন থেকে প্রতিটি ফার্মের ডিম ১২ টাকা, আলু খুচরা পর্যায়ে ৩৫-৩৬ টাকা (হিমাগার পর্যায়ে ২৬-২৭) এবং দেশি পেঁয়াজের দাম হবে ৬৪-৬৫ টাকা। গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ডিম, আলু ও দেশি পেঁয়াজের দাম বেঁধে দেন। এর আগে গত বুধবার কৃষিপণ্যের মূল্য পর্যালোচনা-সংক্রান্ত একটি সভা হয়। এরপর গতকাল এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিম যদি ১২ টাকায় বিক্রির সিদ্ধান্ত যদি ব্যবসায়ীরা না মানেন, তাহলে পণ্যটি আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে। এরই মধ্যে ডিম আমদানির অনুমতি চেয়ে ব্যবসায়ীদের আবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা আছে। এ ছাড়া আলুর বিষয়ে তিনি বলেন, হিমাগার থেকে বেশি দামে আলু বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেলে নিলাম করে নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করে দেওয়া হবে।
টিপু মুনশি বলেন, ‘উৎপাদন খরচ হিসাব করে আমরা দেখেছি ডিম, আলু ও পেঁয়াজ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। সে জন্য আমরা কৃষি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসে এই দাম নির্ধারণ করেছি।’ গত বুধবারের সভায় উপস্থাপন করা সরকারি হিসাবে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাজারে প্রতি হালি ফার্মের ডিম ৫০-৫৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে কোথাও কোথাও ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেটজাত ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকার ওপর। এ ছাড়া আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে। অন্যদিকে দেশি পেঁয়াজের কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা। ডিম আমদানির বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বাজার পর্যালোচনা করে সীমিত আকারে ডিম আমদানির অনুমোদন দেওয়া হবে। যদি ডিম প্রতি পিস ১২ টাকাতেই খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করা হয়, তাহলে আমদানির বিষয়টি অতো গুরুত্ব পাবে না, সীমিত আকারে করা হবে। কিন্তু দাম ১২ টাকায় সীমিত না থেকে বাড়ানো হয়, কিংবা সুযোগ নেওয়া হয়, তাহলে বেশি করে আমদানি করা হবে। বাজার ঠিক রাখার জন্যই আমদানি করা হবে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ভোক্তা অধিকার থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) বাজার মনিটরিং করবেন বলেও জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। এ ছাড়া বাণিজ্যমন্ত্রী সয়াবিন তেলের দাম কমানোর ঘোষণাও দেন। তিনি বলেন, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন দাম ৫ টাকা কমে এখন ১৬৯ টাকা হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, দাম বেঁধে দেওয়া তিন কৃষিপণ্য কী দামে বিক্রি হচ্ছে, সেটি আগামীকাল (আজ) থেকে তদারকিতে নামবে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
বহির্বিশ্বে কয়েক মাস ধরে মুরগির খাদ্যের দাম কমছে; কিন্তু বাড়ছে বাংলাদেশে। এদিকে দেশের ১০টি পোলট্রি ফার্ম ও পোলট্রি সংশ্লিষ্ট সংগঠনের বিরুদ্ধে ডিমের দাম বৃদ্ধিতে বাজারে কারসাজির অভিযোগে মামলা করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন (বিসিসি)। এই প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোলট্রি লিমিটেড, ডায়মন্ড এগ লিমিটেড, পিপলস পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড, নাবা ফার্ম লিমিটেড, বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল, বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ পোলট্রি ফার্ম প্রোটেকশন ন্যাশনাল কাউন্সিল, পোলট্রি প্রফেশনালস বাংলাদেশ ও ইউনাইটেড এগ সেল পয়েন্ট। কমিশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে এবং প্রতিযোগিতা আইন লঙ্ঘনের জন্য দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর তদন্ত, বিচার ও শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এবং প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ এর অধীনে। এই আইনে আদালতে না গিয়ে মামলা নিষ্পত্তির সুযোগ আছে। কমিশনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, দোষী সাব্যস্ত হলে কোম্পানিগুলোকে তিন বছরের গড় টার্নওভারের ১০ শতাংশ পর্যন্ত সর্বোচ্চ জরিমানা করা হতে পারে।প্রতিযোগিতা আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো পণ্য বা সেবার উৎপাদন, সরবরাহ, বিতরণ, মজুত বা অধিগ্রহণে কোনো চুক্তি বা যোগসাজশ করতে পারবেন না, যা প্রতিযোগিতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে বা বাজারে একচেটিয়া প্রভাব তৈরি করবে। চলতি বছরের আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে এক ডজন ডিমের দাম ১৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা পর্যন্ত হয়েছিল। ফলে, সেসময় অনেকেই বিপাকে পড়েন। পরে ডিমের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দুটি কমিটি গঠন করে বিসিসি।
গত ১৩ আগস্ট মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছিলেন, দেশে একটি ডিম উৎপাদনে খরচ হয় প্রায় ১০ টাকা ৫০ পয়সা। তাই খুচরা বাজারে ১২ টাকায় ডিম বিক্রি হলে সবাই লাভবান হবেন। ডিমের মূল্য বৃদ্ধির পর জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালানোর পর দাম কমে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবির) তথ্য বলছে, গত বুধবার এক ডজন ডিম বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকায়। আর গত এক বছরে ডিমের দাম বেড়েছে ১৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ডিম, ব্রয়লার মুরগিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানোর অভিযোগে গত বছর প্রতিযোগিতা কমিশন বেশ কয়েকটি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করলেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি না হলে ও দোষীদের শাস্তি না হলে হঠাৎ যে কোনো পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বন্ধ করা সম্ভব হবে না এবং ভোক্তাদের ভোগান্তি বাড়বে। এবার কমিশন মামলাগুলো দ্রুত শুনানি করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। এর আগে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে চাল, আটা, ডিম, হাঁস-মুরগি ও টয়লেট্রিজ পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার অভিযোগে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৪৪টি মামলা করেছিল বিসিসি। সেই মামলার তালিকায় কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোলট্রি লিমিটেডও আছে। বর্তমানে কমিশনে এসব মামলার শুনানি চলছে।