চার দিকে থৈথৈ পানি। এখানে কোন ফসল ফলত না। সারা বছর জলাবদ্ধ, আনাবাদি ও পতিত পড়ে থাকত এ বিল। জলাবদ্ধ জমিতে এ বছর নতুন উদ্ভাবিত ডালি পদ্ধতিতে সবজি চাষ করা হয়েছে। ডালি পদ্ধতির মাচায় ঝুলে আছে লাউ, কুমড়া, শসা, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গাসহ নানা জাতের সবজি। জলাবদ্ধ জমিতে বাঁশ বসানো হয়। পানির ওপর ওই বাঁশে নেট ও বস্তা দিয়ে ডালি তৈরি করা হয়। ডালিতে মাটি, জৈব সার ও অন্যন্য উপাদান দেওয়া হয়। তারপর ডালিতে রোপণ করা হয় সবজির চারা। পরে সবজির চারা মাচায় বাইয়ে দেওয়া হয়। আর এ মাচায় লতা জাতীয় সবজি উৎপাদিত হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভাসমান বেডে সবজি ও সমলয় চাষ সম্প্রসারণ এবং জনপ্রিয় করণ প্রকল্পের আওতায় এভাবে সবজি চাষ হচ্ছে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতী ইউনয়নের জলাবদ্ধ পুবের বিলে। এ বিলে প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার পৈত্রিক জমি ও অন্যন্য কৃষকরেও জমি রয়েছে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পূবের বিলের অধিকাংশ জমি জলাবদ্ধ, পতিত ও অনাবাদি থাকত। বছরের অধিকাংশ সময় পানির নিচে তলিয়ে থাকা জমি আর শুকনো মৌসুমে হাঁটু বা কোমর পানি থাকায় সেখানে কোনো ফসল উৎপাদন হতো না। বিগত ৫০ বছর ধরে চাষাবাদ না হওয়ায় জমিগুলো পতিত বা অনাবাদি ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি পুবের বিলের পৈতৃক জমি পরিদর্শ করেন। তিনি এ বিলসহ সারাদেশের জলাবদ্ধ পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় আনার নির্দেশ দেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচানি এলাকা টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়ার উন্নয়ন প্রতিনিধি সাবেক সিনিয়র সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার ও কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় টুঙ্গিপাড়ার পুবের বিলে চাষাবাদ শুরু করেন। গত মৌসুমে এ বিলে বোরো ধান উৎপাদিত হয়েছিন। এখন এ বিলে পেন কালচার পদ্ধতিতে মৎস্য চাষ, হাঁস পালন করা হচ্ছে। সেই সাথে জলাবদ্ধ জমিতে ভাসমান বেড, ডালি পদ্ধতি ও রাস্তার খাদে গোড়া পদ্ধতিতে সবজি, ফল, শাক ও মশলা জাতীয় ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভাসমান বেডে সবজি ও সমলয় চাষ সম্প্রসারণ এবং জনপ্রিয় করণ প্রকল্পের পিডি ড. বিজয় কৃষ্ণ বিশ্বাস ডালি পদ্ধতিতে সবজি চাষাবাদ উদ্ভাবন করেছেন। তিনি বলেন, এ পদ্ধতিতে ডালি ও মাচা স্থাপন করে কৃষক এখান থেকে ২ থেকে ৩ বছর পর্যন্ত সবজি ফলন পাবেন। তারপর বাঁশ সেখান থেকে খুলে এনে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন। এ পদ্ধতিতে অর্গানিক সবজি উৎপাদিত হয়। ডালিতে মাটি, কচুরীপানা পচা ও জৈব সার ব্যবহার করা হয়। সবজির পোকামাকড় ফেরমেন ফাঁদ ও জৈব বালাই নাশক দিয়ে দমন করা হয়। এ কারণে ডালি পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজি মানব দেহের জন্য নিরাপদ। এ সবজি খেতে সুস্বাদু। আগামীতে সারা জেলার জলাবদ্ধ পতিত জমিতে ডালি পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। টুঙ্গিপাড়া উপজেলার জোয়ারিয়া গ্রামের তপন বিশ্বাস, পাথরঘাটা গ্রামের সামিউল ফকির, মধুমঙ্গল দাস ও বালাডাঙ্গা গ্রামের অমিত বিশ্বাস বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভাসমান কৃষি প্রকল্পের আওতায় ডালি পদ্ধতিতে চাষাবাদ প্রদর্শনী দেখেছি। আমরা এ বছর হাতে কলমে এ পদ্ধতিতে প্রদর্শনী সবজি উৎপাদনে কাজ করেছি। এতে ফলনও আশানুরূপ হয়েছে। এ পদ্ধতিতে আগামী বর্ষা মৌসুমে আমরা আমাদের জলাবদ্ধ পতিত জমিতে চাষাবাদ করব। এ পদ্ধতিতে রাসায়সিক সার ও কীটনাশক লাগে না। আর একবার শুরু করলে দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। টুঙ্গিপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জামাল উদ্দিন বলেন, পতিত ও জলাবদ্ধ পুবের বিলে চাষাবাদ শুরু করার পর এলাকার মানুষ এ চাষাবাদ নিয়ে হাসাহাসি করত। এখানে আমরা ধানসহ নানা জাতের সবজি, ফল, সমলা, শাক ফলিয়ে সফল হয়েছি। আগামীতে এ বিলের কৃষকরা সারা বছর ব্যাপক আকারে চাষাবাদ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গোপালগঞ্জ খামারবাড়ির উপপরিচালক মো. আঃ কাদের সরদার বলেন, ডালি পদ্ধতিটা গোপালগঞ্জে মডেল হিসেবে এ বছর প্রদর্শনী করা হয়েছে। এতে আমরা কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পেয়েছি। এটা দেখে কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। আগামীতে পতিত ও জলাবদ্ধ জমিতে কৃষকেরা নিজ উদ্যোগে ডালি পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদনে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তাই সামনের বর্ষা মৌসুমে জেলার সব উপজেলায়ও এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ ছড়িয়ে দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজ নির্বাচনী এলাকার উন্নয়ন প্রতিনিধি মো. শহীদ উল্লা খন্দকার বলেন, এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি থাকবে না প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার পর আমি কৃষি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনি এলাকা টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়ার পতিত ও জলাবদ্ধ জমি চাষের আওতায় আনতে কাজ শুরু করি। লাউয়ের সিজনে লাউ হবে, চিচিঙ্গার সিজনে শুধু চিচিঙ্গা হবে আর কিছু হবে না, এ ধারণা এখন বদলেছে। ডালি, ভাসমান বেড.রাস্তার খাদে গোড়া পদ্ধতিতে সব ধরনের সবজি ও ফলমূল সারা বছর ফলছে। বর্ষাকালে আমাদের দেশের অধিকাংশ জমি তলিয়ে যায়। এ পদ্ধতিতে বর্ষাকালে ওই সব জমিতে সবজি চাষ করতে পারি। নাটোরের চিনিডাঙ্গা বিলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রথম এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করে। সেটা সফল হওয়ার পরে আমরা টুঙ্গিপাড়ায় শুরু করেছি। এখানে সফল হয়েছে। এখন এটি কোটালীপাড়া, সদর ও মুকসুদপুর সব জায়গায় ছড়িয়ে দিয়েছি। এখানে শুধু একটা না লাউ, শসা, চিচিঙ্গা, কুমড়া সমস্ত রকম সবজি উৎপাদন করা যাচ্ছে। এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দেখেছেন এবং খুশি হয়েছেন।