কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইয়ামিন হোসেন বলেন, দেশে যারা বড়লোক তারা আরো বড় লোক হচ্ছে, আর যারা গরিব তারা আরো ছোট হচ্ছে। এ কারণে মানব পাচারটা বাড়ছে। দেশে নারী ও শিশুপাচার বেশি হয়। জিডিপি বাড়ছে। আয় খারাপ হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থা সবাই একযোগে এক জায়গায় কাজ করছি। গ্যাপ কমাতে হবে। ইকোনমি কনটেস্টে কাজ করছি। মানব পাচারের শিকার যারা হয়েছে, তাদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে কাজ হবে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে কক্সবাজার শহরের অভিজাত একটি রেস্তোরাঁয় ‘মানব পাচারের ভুক্তভোগীদের জন্য সমন্বনিত প্রচেষ্টা : আমাদের করণীয়‘ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এই কথা বলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী। সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, মানবপাচার আইন নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের আগে ভিকটিমদের কথা শুনতে হবে। প্রয়োজনে কালো গাউন ছেড়ে রোড লেভেলে যেতে হবে। মানবপাচারের শিকার মানুষকে যোগ্যতা অনুযায়ী জীবিকায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
কক্সবাজার জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক লিটন কান্তি চৌধুরী বলেন, বিদেশের কর্মী নির্বাচিত করতে প্রথমে নিবন্ধন করতে হয়। তার আগে পাসপোর্ট করে। সেখানেই বয়স লুকিয়ে পাসপোর্টটি সম্পাদন করে। ম্যানপাওয়ারের ছাড়পত্র নিতে কর্মীকে জনশক্তি কার্যালয়ে হাজির হতে হয় না। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো দায়িত্ব নেয়।
কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর সাকী-এ-কাউছার বলেন, ২০১২ সালে মানবপাচার প্রতিরোধ দমন আইন হয় কিন্তু তা কার্যকর করা হয় ২০১৮ সালে। এই সময়ের মধ্যে বড় ধরনের মানব াচার হয়েছে। পুলিশের অভিযোগপত্রে সংঘবদ্ধ অপরাধে যারা জড়িত, তাদের শনাক্ত করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও আইনজীবীদের মধ্যে যুগ্মভাবে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। দুই পক্ষের মধ্যে কমিটমেন্ট থাকতে হবে। তবে মানবপাচারে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে বেসরকারি সংস্থাগুলো অনেক বেশি সহযোগিতা করছে।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (গোয়েন্দা) দুর্জয় বিশ্বাস বলেন, দেশের ভেতরেও মানবপাচার হয়। ২০১৩, ২০১৪ সালে অনেকগুলো মানবপাচার মামলার তদন্ত করেছি। ২০২৩ সালে এসেও একটি মামলায়ও কোনো সাক্ষীর জন্য ডাকে নাই। তাহলে কত ধীরগতির বিচার হয় তা বুঝতে হবে। কক্সবাজারে মানবপাচার হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কারণ, এ অঞ্চলে বিশাল সমুদ্র রয়েছে। জলসীমা ভালো নজরদারি করা গেলে মানবপাচার প্রতিরোধ সম্ভব।
অ্যাকশন এইড’র প্রোটেকশন লিডার নুজুলি বেগম বলেন, পরিকল্পনার দুর্বলতার কারণে আমরা ভুগছি। পাচারের ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের চিহ্নিত করে সুরক্ষা দিতে হবে। তারা কেমন পরিবার চিহ্নিত করতে হবে। ইউপি লেভেলের কমিটি কার্যকর করে কাজ করা। ইউনিয়ন পরিষদ তার জনশক্তিকে পরিকল্পনায় নিয়ে আসতে না পারলে কাজ হবে না। সমন্বয়ের অভাব প্রখর। কে নেতৃত্ব দিচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় নাকি শ্রম মন্ত্রণালয়- আগে সেটা চিহ্নিত করতে হবে। রোহিঙ্গারা এখান থেকে চলে যাচ্ছে এবং আরো চলে চলে যাবে। তাদের খাবার না দিলে ক্যাম্পে আটক রাখা যাবে না। সে ওখান থেকে বিদেশে গেলে বাংলাদেশের বদনাম হবে। স্থানীয় সরকার যদি আরো সতর্ক এবং কার্যকর না হয়, তাহলে মানবপাচার রুখতে পারব না। মানবপাচারের শিকার ব্যক্তিকে কী কী সার্ভিস দেব, কোনটির পর কী দেব, কিছুই ঠিক নেই। এসব ঠিক করতে হবে। সব কাগজপত্র ঠিক করে গেছে। কিন্তু বিদেশে গিয়ে দেখে সে ওই কাজের জন্য যায়নি। বিদেশে বিভিন্ন স্থানে মেয়েদের নির্যাতন হচ্ছে। মিডিয়া, এনজিও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে রিপোর্ট হচ্ছে। কিন্তু সরকার কী বলেছে- আমার শ্রমিকদের নিরাপত্তা না দিলে আমি শ্রমিক দেব না। কেউ কথা বলছে না। এটা দুঃখজনক।
এনজিও প্ল্যাটফর্ম’র আমির হোসেন বলেন, নির্যাতন হয় বা ট্র্যাপে পড়েন তখন অ্যাম্বাসিগুলো তখন নীরব থাকে। তাদের কোনো সাপোর্ট পায় না। যদি পেয়েও থাকে, তা দীর্ঘায়িত হয়।
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস) প্রকল্প ব্যবস্থাপক শাহিদা পারভিন বলেন, জীবিকার স্থানে পরিবর্তন আনতে হবে। এটি আকর্ষণীয় করতে হবে। জীবিকার ওপর কাজ করতে ছেলে মেয়েরা আর্কষিত হবে। তখন মানবপাচার কমবে। কর্মী পাঠাচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সি সেসবের ডাটাবেজ করতে হবে। ডাটাবেজ করে সরকারকে তদারকি করতে হবে।
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, হ্নীলায় পাঁচটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প আছে। রোহিঙ্গা ঢলের পর পাহাড় গাছগাছালি কিছু নেই। এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে মানবপাচার বন্ধ হচ্ছে না। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনেক দালাল আছে। ওয়ার্ড পর্যায়ে সচেতনতা দরকার। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নজরদারি দরকার।
ইসলামাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর ছিদ্দিক বলেন, বিদেশ যাওয়ার আগে স্থানীয় চকিদার, মেম্বার ও মহিলা মেম্বারদের জানানো দরকার। তখন সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য লেখা থাকবে। এতে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।
ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, মানবপাচার ১০ বছর আগের চেয়ে কমেছে। বিশেষ করে সমুদ্রপথে কমেছে। মানবপাচার প্রতিরোধে মাঠপর্যায়ে আমাদের কাজ করতে হবে। যদি উঠান বৈঠক ওয়ার্ডপর্যায়ে করেন তাহলে ভালো ফল আসবে। স্কুল, কলেজ ও ইমামদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মানবপাচারে রোহিঙ্গা চক্র জড়িত। তারা আমাদের গ্রামেগঞ্জে ঢুকে পড়েছে।
ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ফান্ড (ইউএনএফপিএ) মো. আলমগীর কাদেরী বলেন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড যেতে চেয়ে পাচার হচ্ছেন অশিক্ষিতিরা। কিন্তু শিক্ষত তরুণ যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে তারা বেশি পাচার হচ্ছে ইউরোপে, সাইপ্রাস, ইউক্রেন, গ্রিস। তারা সেখানে মানবপাচারের শিকার হচ্ছেন। এটা অন্য লেভেলে মানবপাচার হয়। সময় এসেছে সেই জায়গায় কাজ করার।
কক্সবাজার জজ আদালতের আইনজীবী বিশ্বজিত ভৌমিক বলেন, কক্সবাজারে মানবপাচার প্রতিরোধে তিনটি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এর মধ্যে ৬৩৮টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। পুলিশি তদন্তের জন্য আছে ৩৬০টি। ভিকটিম, সাক্ষীদের আদালতমুখী করতে পারলে মানবপাচার মামলাগুলোতে রেজাল্ট আসবে।
আইওএম কর্মকর্তা নাজমুন নাহার বলেন, আমরা শুধু অর্থায়নে সীমাবদ্ধ নই। আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছি। তবে সরকারের দায় আরো বেশি। সামাজিক সুরক্ষার জায়গায় সরকার বেশি কাজ করতে পারবে। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজিবী সমিতির প্রোগ্রাম অ্যান্ড অপারেশন বিভাগের পরিচালক নাফিস ইমতিয়াজ হাসান।