নাটোর সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের শতভাগ মানুষ কৃষির সঙ্গে জড়িত। পূর্ব পুরুষের হাত ধরে আসা চিরাচরিত নিয়মে চলা কৃষিব্যবস্থার পরিবর্তন করে এই গ্রামের কৃষক আধুনিক কৃষির সংস্পর্শে এসেছেন কিছুটা দেরিতে। তবে তাদের নতুন কিছু করার ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা সাফল্য এনে দিয়েছে। একসময় গ্রামের সব কৃষকই ধান, পাট, গম চাষ করলেও বর্তমানে গ্রামটির অন্তত ৪০ জন কৃষক আধুনিক পদ্ধতিতে ‘তাল বেগুন’ চাষ করে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ১৫০ মণ ‘তাল বেগুন’ উৎপাদন হয় এই এলাকায়। এই বেগুনকে কেন্দ্র করে গ্রামটিতে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আড়ত। যেখানে সকাল থেকেই গ্রামের বিভিন্ন খেত থেকে বেগুন নিয়ে আসেন কৃষক। উৎপাদিত এই বেগুন কিনতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় থেকে আসেন বেপারিরা। এ গ্রামের দেখাদেখি আশপাশের অন্তত ১০টি গ্রামে তাল বেগুনের চাষ শুরু হয়েছে। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, আড়তগুলোতে তাল বেগুনের একেকটি স্তূপ। সেখানে একদিকে কৃষকদের নিয়ে আসা বেগুন পরিমাপ, বাছাই ও বস্তাজাতকরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন আড়তের শ্রমিকরা। আবার তাল বেগুনের ক্ষেতে গেলে দেখা যায় একদিকে বেগুন হারভেস্ট করা অন্যদিকে গাছ পরিচর্যা ও কীটনাশক প্রয়োগে ব্যস্ত রয়েছেন বেগুন চাষিরা। বেগুনের আড়তে কথা হয় কৃষক আমানুল্লাহ সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি দুই বিঘা জমিতে তাল বেগুনের চাষ করেছি। সপ্তাহে দুই-তিন দিন বেগুন তুলি। আজকে আড়তে ৫ মণ বেগুন নিয়ে এসেছি। প্রতি মণ ১ হাজার ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করে বিল হয়েছে ৯ হাজার টাকার মতো। তিনি বলেন, এই দামে বেগুন বিক্রি করে আমরা বেশ লাভবান হচ্ছি। তবে যদি বেগুনে ব্যবহৃত কীটনাশকের দাম একটু কম হতো তাহলে আরো বেশি লাভ করতে পারতাম। গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার কৃষক নবীর হোসেন বলেন, তিন ছেলে ও এক মেয়েসহ ছয় সদস্যর সংসার আমার। বাড়ির পাশের ছোট একটু জমিতে চাষাবাদ আর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো। বছর দুয়েক আগে পরিচিত একজনের মাধ্যমে উচ্চফলনশীল তাল বেগুনের কথা জানতে পারি। তারপর প্রথমে ১০ কাটা জমিতে শুরু করি এর চাষ। সেই জমিতে ভালো ফলন পেয়ে অটোরিকশা বিক্রি করে মনোযোগ দিয়ে তাল বেগুন চাষে নেমে পড়ি। তার পরের বছর জমি বর্গা নিয়ে ২ বিঘায় এই বেগুন চাষ করি। পরিবারের অন্য সদস্যদের সহযোগিতায় এখন গ্রামে তাল বেগুন চাষে সফল চাষি হিসেবে পরিচিত হয়েছি। আরেক বেগুন চাষি লালন হোসেন বলেন, অন্যান্য ফসলের চেয়ে এটার বিপণন ব্যবস্থাটা ভালো। তাই অন্যদের দেখে উৎসাহিত হয়ে প্রথমে ১ বিঘা ও বর্তমানে ২ বিঘা জমিতে তাল বেগুনের চাষ করছি। অন্য সব ফসলের চেয়ে তাল বেগুনে কয়েক গুণ বেশি পরিচর্যা করতে হয়। প্রতিদিন ক্ষেতে ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হয়। তবে এত কষ্ট হলেও সারাবছর এর দাম থাকায় এবং গ্রাম থেকেই বেপারিরা নিয়ে যাওয়ায় ভালো লাভ করতে পারেন তারা। তিনি আরো বলেন, আমি ২ বিঘা জমিতে তাল বেগুন চাষ করেছি। যেখানে এখন পর্যন্ত ৪ লাখ টাকার বেগুন বিক্রি করেছি। খেতে এখনো অনেক বেগুন আছে সেগুলো ধীরে ধীরে বিক্রি করব। তাল বেগুন চাষে কোনো রোগ বালাই বা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় আপনাদের? এমন প্রশ্নের জবাবে এই কৃষক বলেন, তাল বেগুনের গাছে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রোগবালাইয়ের আক্রমণ হয়। যার জন্য প্রতিদিন আমাদের গাছে পরিচর্যা ও সাপ্তাহে ৩ থেকে ৪ দিন কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। বর্তমানে বেগুন গাছে ফুল পড়া, ডাল পচা, বেগুনে ভাইরাস আক্রমণসহ গাছ মরে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে এসব সমস্যা সমাধানে স্থানীয় কৃষি বিভাগের কেউ পরামর্শ ও সহযোগিতা না করার অভিযোগ করেন এই কৃষক। তিনি বলেন, আমাদের গ্রামে অনেক কৃষকের ভাগ্য খুলেছে এই বেগুন চাষের মাধ্যমে। কিন্তু বেগুন চাষে মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য পরামর্শ বা সহযোগিতা আমরা কৃষি বিভাগের কারো থেকে পাই না। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে সদর উপজেলায় তাল বেগুনের চাষ হয়েছে ১৬ হেক্টর জমিতে। যেখানে উৎপাদিত তাল বেগুনের পরিমাণ ৪০০ মেট্রিক টন। নাটোর সদর উপজেলা কৃষি অফিসার নীলিমা জাহান বলেন, তাল বেগুনসহ বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল জাতের বেগুন চাষ হচ্ছে সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। এতে কৃষকরা বেশ লাভবান হচ্ছেন। রাজশাহী থেকে আড়তে তাল বেগুন কিনতে আসা বেপারি হাসান আলী বলেন, নাটোরের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে প্রচুর তাল বেগুনের চাষ হয়। এখানকার বেগুন মানের দিক থেকেও উন্নত, যার কারণে ঢাকাতে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমরা বেগুন কিনতে আসার আগের দিন ফোনে কৃষককে বেগুনের রেট জানিয়ে দিই। পরের দিন এসে ওজন করে ভালোভাবে বস্তাজাত করে ঢাকার কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন আড়তে পাঠাই। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা আছে- এমন জমিতে এই জাতের বেগুন চাষ করা যায়। বর্ষাকালে সবজির অনেক ঘাটতি থাকে, ফলে এই সময় তাল বেগুন সবজির এই ঘাটতি অনেকটাই লাঘব করে। প্রতিটি তাল বেগুনের ওজন ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। নাটোরের স্থানীয় বাজারে এই বেগুনের চাহিদা কম থাকলেও ঢাকায় এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ফলে কৃষক সারা বছরই ভালো দাম পান।