রুপালি পর্দায় ভৌতিক সিনেমার কথা বলতে বসলে ‘দ্য এক্সরজিস্ট’ ছবিটার কথা বাদ দেওয়া মুশকিল। এহেন ছবিকে ঘিরেও রয়েছে এক সত্যের পরত। ১২ বছরের রেগান নাম্নী বালিকার জীবন নাকি সত্যিকারের এক ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল! তবে সে বালিকা নয়, বালক। যদিও সেই কাহিনি রয়ে গিয়েছিল লোকচক্ষুর অনেকটাই আড়ালে। কিন্তু ২০২০ সালে তার মৃত্যুর পরে নতুন করে অনেক তথ্য সামনে আসে, যা সত্যিই অবাক করে দেয়। সেকথায় যাওয়ার আগে ‘দ্য এক্সরজিস্ট’ নামের ছবিটির কাহিনি ও তার জনপ্রিয়তাকে একবার ফিরে দেখা দরকার। ‘যেমন জল জমিয়া বরফ হয়, অন্ধকার জমিয়া তেমনি ভূত হয়।’ ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় সেই কবে একথা লিখেছিলেন ‘লুল্লু’ নামের সেই আশ্চর্য কাহিনিতে। এই বাক্যটি আজও এক পরম সত্যকে বহন করছে। যখনই ভৌতিক কোনো কাহিনি সাড়া ফেলে, তখনই তার জনপ্রিয়তাকে বুঝতে গেলে সময়টাকে বোঝা দরকার হয়ে পড়ে। ‘দ্য এক্সরজিস্ট’ নামের হাড়হিম অলৌকিক ছবিটির কথা বলতে গেলেও সেটা সবার আগে করা দরকার। সে এক অদ্ভুত সময়। একদিকে মহাকাশ যুগ শুরু হয়েছে। মানুষের পা পড়েছে চাঁদে। অথচ একই সঙ্গে লাফিয়ে বাড়ছে শয়তানের উপাসকদের রমরমা! আসলে আমেরিকাণ্ডরাশিয়ার ঠান্ডা যুদ্ধ তখন চরমে। এই বুঝি একটা বোতাম টিপে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করল কোনো দেশ, এমন আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে! মানুষের মনে হচ্ছে, প্রলয় কেবল সময়ের অপেক্ষা। তাই অন্ধকার বিশ্বাসের প্রতি আচ্ছন্নতাও বাড়ছে। সেই প্যারানইয়ার প্রভাব পড়েছিল রুপালি পর্দাতেও। ১৯৬৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রোজমেরি’স বেবি’ থেকে একটা ট্রেন্ড শুরু হয়েছিল, যা চরমে পৌঁছায় ১৯৭৩ সালে। সর্বকালের অন্যতম সেরা ভয়ের ছবি ‘দ্য এক্সরজিস্ট’ মুক্তি পায় সেই বছরই। সেই হিসাবে এ বছরের ডিসেম্বরে সিনেমাটির ৫০ বছর পূর্তি। পাঁচ দশক আগে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটি আজও এক বালিকার প্রেতাবিষ্ট হওয়ার ভয়াল অথচ করুণ আখ্যান হয়ে রয়ে গেছে। ছবির মূল চরিত্রের নাম রেগান। ওউইজা বোর্ড নিতে খেলতে খেলতে সে ডেকে ফেলে এক শয়তানি অস্তিত্বকে। আর তারপর ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু ১৯৭৩ সালের এই ছবি এবং তারও আগে ১৯৭১ সালে প্রকাশিত এক সমনামী উপন্যাস নাকি আসলে বাস্তবেরই ছায়া অবলম্বনে সৃষ্ট। সেই ‘সত্যি’ কাহিনির নায়কের নাম রোনাল্ড ডো (অনেকের মতে তার আসল নাম রোনাল্ড হাঙ্কলার)। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে খবরের কাগজে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল রোবি তথা রোনাল্ড নামের এক ১৪ বছরের বালকের ভূতগ্রস্ত হয়ে পড়ার খবর। এক জার্মান লুথেরান পরিবারের সেই বালক জন্মদিনে ওউইজা বোর্ডের বায়না করেছিল। কাকিকা হ্যারিয়েট তাকে সেটা কিনেও দেন। আর তারপরই শুরু হয় বিপত্তি। ঠিক সঙ্গে সঙ্গে নয়। কাকিমার মৃত্যুর পর থেকে। ছেলেটি দাবি করে নানা ধরনের অলৌকিক ঘটনার নাকি সে সাক্ষী হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে তাদের বাড়িতে এমন কিছু বা কেউ রয়েছে, যারা ভয়ংকর। কে যেন দেওয়াল বেয়ে হেঁটে বেড়ায়। অদ্ভুত সব শব্দ হয়। জিনিসপত্র উড়ে বেড়ায় আচমকাই। শোনা যায়, রোনাল্ডের কাকিমার মৃত্যুর পর তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছিল ওই বোর্ডের সাহায্যে। এরপর দেখা যা ঘুমন্ত রোনাল্ডের সারা শরীরে আঁচড়ানোর দাগ! সেই শয়তানি শক্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে তারা দ্বারস্থ হন নানা ‘ওঝা’র। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত তাদের মুশকিল আসান হয়ে অবতীর্ণ হন ফাদার রেমন্ড জে বিশপ। তিনি এক্সরজিসমের সাহায্যে বিপন্মুক্তি ঘটাতে সচেষ্ট হন। দেখা যায় রোনাল্ডের বালিশের তলায় ক্রুস রাখতেই আসবাবগুলো নাকি চলতে শুরু করেছে! বিছানার গদি কাঁপছে থরথর করে। ক্রুস ছিটকে পড়ে খাটের কোনায়! কেবল বাড়িতেই নয়, জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল বা দ্য অ্যালেক্সিয়ান ব্রাদার্স হাসপাতালেও একের পর এক এক্সরসিজম প্রয়োগ করা হয় তার উপরে। আর প্রতিবারই রোনাল্ড নানা আশ্চর্য সব কাজ করতে শুরু করে। ল্যাটিনে অনর্গল কথা বলা, বিছানায় প্রস্রাব, বমি, থুতু ফেলা, অদ্ভুত কঠিন ঘর ঘরে গলায় কথা বলা! হ্যাঁ, ‘দ্য এক্সরজিস্ট’ ছবিটির সঙ্গে সবটাই মিলে যেতে থাকে। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। শয়তানি শক্তির হাত থেকে রক্ষা পায় সে। তবে ঠিক কী হয়েছিল তার সঙ্গে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছেই। অনেকেরই দাবি, রোনাল্ড ডো’র আসল নাম রোনাল্ড হাঙ্কলার। তিনি বড় হয়ে নাসায় যোগ দেন। ১৯৬৯ সালের চন্দ্রাভিযানের এক গুরুত্বপূর্ণ ইঞ্জিনিয়ার। যদি সত্যিই তাই হয়, তাহলে এও এক অদ্ভুত সমাপতন! চাঁদে মানুষের পা রাখা বিজ্ঞানের এক সদর্প পদক্ষেপ। রোনাল্ডের নাম জড়িয়ে এর সঙ্গে। আবার শয়তানি শক্তির মতো অলৌকিকতায় মোড়া তার শৈশব। ২০২০ সালে নিজের ৮৬তম জন্মদিনে আকস্মিক স্ট্রোকে মারা যান রোনাল্ড। মেরিল্যান্ডে নিজের বাড়িতে। নিজের শৈশবের সেই অভিজ্ঞতার কথা তিনি নাকি গোপনই রাখতেন। খুব কাছের লোক ছাড়া শেয়ার করতেন না। শোনা যায়, প্রতি হ্যালোউইনে নিজের বাড়িতে নাকি থাকতেন না ২০০১ সালে নাসা থেকে অবসর নেয়া রোনাল্ড। তার ভয় ছিল, ওই দিন সেই পুরোনো আতঙ্ক আবার হানা দিতে পারে তার বাড়িতে! ছয়ের দশকের শেষে উইলিয়াম ব্ল্যাটি নামের এক লেখক রোনাল্ডের কথা জানতে পেরে সেটার উপর ভিত্তি করেই লেখেন ‘দ্য এক্সরজিস্ট’। বাকিটা সত্যিই ইতিহাস। ছবি ‘দ্য এক্সরজিস্ট’ নিয়েও নানা আতঙ্কঘন মিথ। ছবির শুটিং চলাকালীন নাকি প্রায়ই নানা প্যারা নরম্যাল ঘটনার সাক্ষী হতেন ছবির কুশীলবরা। শুটিং চলাকালীন দুইবার আগুন লাগে সেটে। এবং শুটিং শেষ হওয়ার পরই মারা যান ছবির অন্যতম জ্যাক ম্যাকগোরান এবং দু’জন টেকনিশিয়ানও। এসব শুনে যে কেউই বাঁকা হাসি হাসবেন। কেউ আবার এই যুগেও কী করে এমন সব অলৌকিক কাহিনিকে সত্যি বলে দাবি করা হয়, তা ভেবে বিস্মিত হবেন। কিন্তু যে কোনো অলৌকিকতা আসলে বাস্তবের কিনার ঘেঁষে এমন এক যাত্রার কথা বলে, বিজ্ঞান যাকে কোনোদিন পাত্তা দেয়নি। তবু বারবার ফিরে ফিরে আসে অন্ধকারের শরীরে জেগে ওঠা শয়তান। তার দুর্দম উপস্থিতি আজও অনুভব করার কথা বলেন কত মানুষ! সেসব বিশ্বাস করার মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। কিন্তু বর্ষার সন্ধ্যা, শীতের রাত কিংবা আচমকা লোডশেডিংয়ে গরমকালে এসব গল্পের যে আজও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, সেটাকে অবিশ্বাস করার কোনো জায়গা নেই।