মেহেরপুরের মৎস্য চাষিরা পুকুর ও ছোট জলাশয়ে দেশীয় জাতের মাছ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। শিং, কৈ, মাগুর, বাইম, ট্যাংরা, টাকি, শোল ও পাবদাসহ বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ চাষ হচ্ছে মেহেরপুরের বিভিন্ন পুকুর ও জলাশয়ে। বিলুপ্তির হাত থেকে দেশীয় মাছ রক্ষায় পুকুর মালিকদের উদ্বুদ্ধসহ কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে বেসরকারি সংস্থা পলাশীপাড়া সমাজ কল্যাণ সমিতি। মাছ চাষে নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। দেশীয় মাছ চাষ করে অধিক মুনাফা পাওয়ায় অন্যান্য মাছের পাশাপাশি দেশীয় জাতের মাছ চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এতে আর্থিক সহায়তা করছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সমন্বিত কৃষি ইউনিটভুক্ত মৎস্য খাত। বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির মাছ চাষের এ প্রকল্পের আওতায় মৎস্য চাষিদের দিয়ে রাইখর, শিং, মাগুর, চ্যাং, ট্যাংরা, তারা বাইম, পুঁটি, কৈ, শোল, মলাসহ অন্যান্য প্রজাতির মাছ চাষ অব্যাহত রয়েছে। গাংনী উপজেলার তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামের মোশাররফ হোসেন। তিনি একজন আইনজীবী। আইন পেশার পাশাপাশি তিনি দীর্ঘদিন ধরে মৎস্য চাষের সঙ্গে জড়িত। নিজ গ্রামে ৩ বিঘা জলাশয়ে অন্যান্য মাছের সঙ্গে শিং, মাগুর, চ্যাং, ট্যাংরা, তারা বাইম, পুঁটি, কৈ, শোল, চাষ করেছেন। পরিবারের চাহিদা পূরণ করে তিনি মাছ বিক্রি করে ভালো লাভবান হচ্ছেন। ভাটপাড়া গ্রামের পুকুর মালিক মারুফ আযম বলেন, বর্তমানে যেসব নদী বা বিল অবশিষ্ট আছে, তাও কীটনাশকের ব্যবহার ও পর্যাপ্ত পানি না থাকায় মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে অনুকূল পরিবেশের অভাবে দেশীয় প্রজাতির মাছ পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। একটি পুকুরে পরিবারের চাহিদা পূরণের জন্য কৈ, টাকি, শোল, শিং, ও ট্যাংরা মাছ চাষ করেছি। এতে পরিবারের চাহিদা পূরণ হচ্ছে অন্যদিকে বছরে দুইবার মাছ বিক্রি করে লক্ষাধিক টাকা বাড়তি আয় হয়েছে। মৎস্য চাষি মোশাররফ হোসেন বলেন, মেহেরপর জেলায় খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ার ফলে দেশীয় জাতের মাছ অনেকটা বিলুপ্তির পথে। ৫ বছর আগে খাল-বিলে যেসব মাছ প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠত, সেই সব মাছ পানি না থাকায় প্রায় বিলুপ্ত। পরে পলাশীপাড়া সমাজকল্যাণ সমিতির মৎস্য কর্মকর্তার পরামর্শ ও তাদের দেওয়া দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা নিয়ে পুকুরে চাষ শুরু করি। আমার পরিবার ও আত্মীয় স্বজনের চাহিদা পূরণ করেও বছরে কয়েক লাখ টাকার মাছ বিক্রি করি। আমার এই মাছ চাষ দেখে এলাকার অনেক পুকুর মালিকরা ঝুঁকছে দেশীয় জাতের মাছ চাষের দিকে।
সংস্থার মৎস্য কর্মকর্তা সাঈদ-উর-রহমান জানান, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়াসহ অন্যান্য কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছ অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। এজন্য আমরা এই মাছগুলো বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য চাষিদের অনুপ্রাণিত করছি। দেশি মাছের চাহিদা ও দাম বেশি হওয়ায় চাষিরা অন্যান্য মাছের পাশাপাশি দেশীয় মাছ চাষ করে দ্বিগুণ মুনাফা অর্জন করছেন। মাছ চাষ সম্প্রসারণে পোনা ও উপকরণ সহায়তার পাশাপাশি মুক্ত জলাশয়ে পোনা অবমুক্তকরণ কার্যক্রমও আমরা বাস্তবায়ন করছি। পিএসকেএস’র নির্বাহী পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা প্রদান, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি কৃষক বা খামারির দক্ষতা উন্নয়নে পিএসকেএস পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহায়তায় কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এরই ধারাবাহিকতায় মেহেরপুরের গাংনী উপজেলাতে আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আমরা সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছি। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য চাষের গুরুত্ব অপরিসীম। শিং, কৈ, মাগুর, বাইম, ট্যাংরা, টাকি, শোল ও পাবদাসহ বিলুপ্ত হওয়া জাতের মাছ আবহমান কাল থেকে বাঙালিদের কাছে অনেক প্রিয়।
খেতে সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। মেহেরপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. রোকনুজ্জামান বলেন, বিগত দশক ধরে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলাশয় ভরাট, বৃষ্টির অভাবে খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ার ফলে মেহেরপুর জেলাতে দেশীয় জাতের মাছ মাছ পাওয়া দুষ্কর। আমরা বিভিন্ন পুকুর মালিককে বিভিন্ন পরামর্শের মাধ্যমে দেশীয় জাতের মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করছি। পাশাপাশি পলাশীপাড়া সমাজকল্যাণ সমিতি বিভিন্ন গ্রামে সহায়তা দিচ্ছে পুকুর মালিক ও মৎস্য চাষিদের। অনেকেই দেশীয় জাতের মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। দিন দিন এর পরিধি বাড়ছে। কয়েক বছরের মধ্যে অন্যান্য মাছের মতোই দেশীয় মাছ বাজারে পাওয়া যাবে।