মোস্তফা কামাল (৭০) ও মেয়ের জামাই মো. মহসিন (৪০)। ভাগ্যবদলাতে বিগত ৮ বছর আগে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় শুরু করেন ঘানিতে ভাঙানো খাঁটি সরিষার তেলের ব্যবসা। আর শিল্পাঞ্চল আশুলিয়াতে এটিই ঘানিতে ভাঙানো সরিষার তেল উৎপাদনের একমাত্র প্রতিষ্ঠান। খাঁটি সরিষার তেল বিক্রি করে তাদের ভালোই চলছে। তবে সরকারি কিংবা আধা-সরকারি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের সহজ শর্তে ঋণ দান করলে এই ব্যবসা আরো প্রসার ঘটাতে পারবেন বলে দাবি তাদের।
মোস্তফা কামাল মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা গ্রামের মৃত আইজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি বর্তমানে আশুলিয়ার কাঠগড়া সেলিমের বাড়ির ভাড়াটিয়া। মেয়ের জামাই মহসিনও তার সাথেই থাকেন এবং একসাথে ঘানির তেলের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, কাঠের ঘানির সাহায্যে ফোঁটা ফোঁটায় নিংড়ানো খাঁটি সরিষার তেলের চাহিদা একসময় সাভারসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হাটবাজারে বিক্রি করা হতো। এই তেল বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন কলু সম্প্রদায়ের মানুষ। সাভার, আশুলিয়া ও মানিকগঞ্জে এই সম্প্রদায়ের মানুষ ঘানি ভাঙানো তেল ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত ছিল। গ্রামবাংলার অতি পরিচিত এই দৃশ্যটি এখন আর চোখে পড়ে না। এখন যন্ত্রচালিত তেল পাওয়া যায় সর্বত্র। তবে ঢাকার অতি সন্নিকটে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার কাঠগড়া বাজারে ঐতিহ্য ও সনাতন পদ্ধতিতে খাঁটি সরিষার তেল উৎপাদনকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন জামাই-শ্বশুর। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে এ খাঁটি সরিষার তেল আশুলিয়াসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় খ্যাতি ছড়িয়েছে। সরেজমিন আশুলিয়ার কাঠগড়া বাঁশপট্টিতে ঘানি ভাঙানো খাঁটি সরিষার তেলের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, ঘাড়ে ঘানি আর চোখে মোটা কাপড়ের পর্দা দিয়ে বাঁধা চারদিকে ঘুরছে কলুর বলদ। সেই সাথে কাঠের তৈরি ঘানিও ঘুরছে এবং সরিষা পিষে তা থেকে বের হচ্ছে খাঁটি সরিষার তেল। সেই তেল আবার ধীর গতিতে জমা হচ্ছে নিচে রাখা সিলভারের পাতিলে। এ তেলে কদর ছড়িয়ে পড়েছে পুরো আশুলিয়াতে।
এ ব্যাপারে কথা হয় কারখানার মালিক মোস্তফা কামালের সাথে। তিনি জানান, দীর্ঘ প্রায় ৮ বছর আগে গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ থেকে কর্মের সন্ধানে চলে আসেন আশুলিয়ায়। বাপ-দাদার ঘানির ব্যবসা ছাড়া অন্য কোনো কাজ তেমন জানেন না তিনি। তাই কি করবেন কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না। শেষে মেয়ের জামাই মহসিনের সাথে পরামর্শ করে বিগত ৮ বছর আগেই আশুলিয়ার কাঠগড়া বাজারে মেসার্স মহিমা গুরুর ঘানি স্টোর নাম দিয়ে শুরু করেন ঘানি ভাঙানো খাঁটি সরিষার তেলের ব্যবসা। প্রথম প্রথম তেমন বেচা-বিক্রি কম হলেও এখন মোটামোটি বিক্রি ভালো। তার ঘানির কারখানায় এখন দুইজন শ্রমিকও কাজ করেন। সব খরচ বাদ দিয়ে যা থাকে, খুব ভালোভাবেই সংসার চলে যাচ্ছে তাদের।ঘানির তেল কিনতে আসা আমিরুজ্জামান টুটুল জানান, তিনি নিয়মিত এখান থেকে ঘানির তেল কিনে থাকেন। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, এটা খাঁটি সরিষার তেল। ঘানির তেলে কোনো ভেজাল করা যায় না। তাই তিনি ঘানিতে ভাঙানো সরিষার তেল নিয়ে থাকেন। সফিকুল ইসলাম নামে তেল কিনতে আসা আরেকজন জানান, প্রথমে তিনি তার ছোট বাচ্চার শরীরে সরিষার তেল মাখানোর জন্য এখান থেকে তেল নিয়ে যেতেন। কিন্তু এখন রান্নার কাজে ব্যবহার করতে এই তেল নিয়ে যান। ভেজালের ভিড়ে এই তেলটা একদম খাঁটি। কারণ, এটা চোখের সামনেই তৈরি হচ্ছে। মেয়ের জামাই মো. মহসিন জানান, ৮ বছর আগেই শ্বশুরের সাথে তিনি ঘানিতে তেল ভাঙানো শুরু করেন। তাদের এই কারখানায় এখন দুটি গরু রয়েছে। দুটি গরু দিয়েই প্রতি ঘণ্টায় বদল করে ঘানি টানা হয়। একটি গরু একটানা ১ ঘণ্টার মতো ঘানি টানে। প্রতিদিন এক মণের মতো সরিষা ভাঙানো যায় ঘানিতে। এক মণ সরিষায় খাঁটি সরিষার তেল বের হয় ১৩ থেকে ১৪ কেজি। আবার খৈলও বের হয় ২৫/২৬ কেজি। কোনো কিছুই ফেলানো যায় না। প্রতি কেজি তেল বিক্রি করেন ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি দরে। আর খৈল বিক্রি হয় ৭০ টাকা কেজি দরে। তিনি জানান, প্রথম প্রথম তেমন বিক্রি হতো না দাম একটু বেশি রাখার কারণে। কিন্তু মানুষজন যখন এই তেল খেয়ে ভালো মনে করেছে, তখন থেকে বিক্রিও বেড়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, দুটি গরুই তাদের বছরের সেরা আয়টা দেয়। একটি গরু যদি ১ লাখ টাকা দিয়ে ক্রয় করি, সেটি দিয়ে ঘানি ভাঙানোর কাজ করানো হয়, তাহলে ওই ষাড় গরুটাই ১ বছর পর ভালো খেয়ে মোটাতাজা হয় প্রাকৃতিকভাবেই। আর কোরবানির ঈদে সেটা প্রায় ডাবল দামে বিক্রি করা সম্ভব হয়। আর এটার চাহিদাও ওই সময় বেশি থাকে। তাই এ থেকেই ভালো একটা আয় বেরিয়ে আসে। সব মিলিয়ে তাদের ভালোই চলছে। এখন তাদের এই কারখানায় দূর দূরান্ত থেকেও মানুষ তেল কিনতে আসেন। তবে সরকারি বা আধাসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান যদি সহজ শর্তে ঋণ দিত, তাহলে এই ব্যবসাটা আরো বড় করা যেত। সরকার এ শিল্পের প্রতি একটু নজর দিলে এটা আরো বিস্তার লাভ করানো সম্ভব হবে।