চট্টগ্রামে খুনের পর লাশ কেটে ফেলা দেয়া খণ্ডিত মাথার খোঁজে গতকাল সোমবার দিনভর পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে থাকা নিহত ব্যক্তির পুত্রবধূর দেখানো মতে তল্লাশি চালালেও সেই মাথার খোঁজ এখনো মেলেনি। তবে লাশ কাটায় ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্রটি উদ্ধার করেছে পিবিআই। গত রোববার ভোরে পুত্রবধূ আনারকলিকে নিয়ে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে যায় পিবিআই টিম। জোয়ারের কারণে বেলা গড়াতে ফিরে এলেও বিকেলে ফের গিয়ে তল্লাশি চালানো হয়। গতকাল সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আরেক দফা তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু খণ্ডিত মাথা পাওয়া যায়নি। তবে আজ মঙ্গলবার আবারো তল্লাশি চালানো হবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিটের পরিদর্শক মো. ইলিয়াস খাঁন বলেন, পতেঙ্গায় টানেলের প্রবেশমুখে একটি পুলিশ বক্স আছে। এর পেছনে পাথরের ব্লকের ভেতরে খণ্ডিত মাথাটি আছে বলে গ্রেপ্তার আনারকলি আমাদের দেখিয়ে দেন। আমরা কয়েকঘণ্টা তল্লাশি চালিয়েছি। সেখানে লাশ পচা দুর্গন্ধ পেয়েছি, কিন্তু জোয়ার চলে আসার কারণে মাথাটি পাওয়া যায়নি। আমাদের ধারণা, ব্লকের ভেতরে মাথাটি এখনও আটকে আছে। আজ ভোরে ভাটার সময় আবারও তল্লাশি চালানো হবে। খুনের শিকার মো. হাসান (৬১) চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার কাথারিয়া ইউনিয়নের বড়ইতলী গ্রামের সাহাব মিয়ার ছেলে।
গত ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নগরীর পতেঙ্গা বোট ক্লাবের অদূরে ১২ নম্বর গেটে একটি ট্রলিব্যাগ পাওয়া যায়। কফি রঙের ট্রলিব্যাগে ছিল মানব শরীরের দুই হাত, দুই পা, কনুই থেকে কাঁধ এবং হাঁটু থেকে উরু পর্যন্ত অংশ। এ ঘটনায় পতেঙ্গা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল কাদির বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এর দুই দিনের মাথায় ২৩ সেপ্টেম্বর সকালে নগরীর আকমল আলী সড়কের খালপাড়ে একটি খাল থেকে বস্তাবন্দি অবস্থায় টেপে মোড়ানো শরীরের আরেকটি খণ্ড উদ্ধার করে পিবিআই। এছাড়া আঙ্গুলের ছাপ ও নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে নিহত ব্যক্তির পরিচয়ও নিশ্চিত করা হয়। গ্রেপ্তারর করা হয় স্ত্রী ছেনোয়ারা বেগম (৫০) ও বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানকে (৩২)। তাদের পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
২৭ সেপ্টেম্বর আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বাবাকে খুনের লৌমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান জানান, প্রায় ২৮ বছর নিখোঁজ থাকার পর ২ বছর আগে পরিবারের কাছে ফিরে আসেন হাসান। ফিরেই তিনি ভিটেমাটি বিক্রি করে দেয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। এ নিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে তার বিরোধ বাঁধে। ২০ সেপ্টেম্বর সকালে হাসান ও তার স্ত্রী, বড় ছেলে মোস্তাফিজুর নগরীর ইপিজেড থানার আকমল আলী সড়কের পকেট গেট এলাকার জমির ভিলায় ছোট ছেলে সফিকুর রহমান জাহাঙ্গীরের বাসায় ছিলেন। সেখানে বাবা ও দুই ভাইয়ের মধ্যে এ নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়। এর মধ্যেই বড় ছেলে তার গলা টিপে ধরলে মারা যান হাসান। ঘটনা জানাজানি হওয়ার ভয়ে দুই ভাই মিলে লাশ গুমের উদ্দেশে সেটি কেটে কয়েক টুকরো করে সেগুলো বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেন।
এদিকে, গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় বাবার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ছোট ছেলে সফিকুর রহমান জাহাঙ্গীরের স্ত্রী আনারকলিকে। তবে সফিকুর এখনও পলাতক আছেন। গত শনিবার আনারকলিকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের নির্দেশে তিন দিনের রিমান্ডে নেয় পিবিআই।
পিবিআই পরিদর্শক ইলিয়াস খাঁন বলেন, আনারকলি সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত নন, তবে আলামত গোপনের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত উপাদানের জোগানও তিনি দিয়েছেন বলে আমাদের কাছে স্বীকার করেছেন। তার দেওয়া তথ্যানুযায়ী আমরা ঘটনাস্থলের পাশের ভবনের পেছনে ময়লার স্তূপ থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ধামাটি উদ্ধার করেছি। এরপর তার দেখানো মতে আমরা পতেঙ্গায় গিয়ে মাথার খোঁজে তল্লাশি চালিয়েছি। হত্যার পরদিন সকাল ৭টার দিকে আনারকলি ও তার স্বামী পতেঙ্গায় গিয়ে পাথরের ব্লকের ভেতরে মাথাটি ফেলে দেন বলে আমাদের জানিয়েছেন।
পিবিআই টিমের সঙ্গে থাকা আনারকলি সাংবাদিকদের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘ঘটনার দিন (২০ সেপ্টেম্বর) সকালে আমি আব্বাকে (শ্বশুর) চা-বিস্কুট দিয়ে আমার শাশুড়ির রুমে চলে যাই। পরে আমি বেরিয়ে পাশের বাসার আন্টির বাসার সামনে বসে দুইজনে গল্প করতে থাকি। তখন আমার স্বামী সফিকুর এসে আমাকে বলে, আজ তুমি আন্টির রান্না ঘরে রান্না করো। আমি বললাম- বাসায় গ্যাস আছে, আমি আন্টির বাসায় কেন রান্না করব। তখন সে আমাকে বিশ্রি গালি দেয়। আমি আন্টির রুমে চলে যাই।
আন্টি বেরিয়ে আমাদের বাসায় কী হচ্ছে- সেটা দেখতে যান। ফিরে এসে বলেন, আমার রুমে নাকি দুই ভাই মিলে আব্বাকে হাত-পা বেঁধে ফেলছে। আমি বের হয়ে জানালা দিয়ে দেখি, দুই ভাই আমার শ্বশুরকে একটা বস্তার ভেতরে ঢোকাচ্ছে। তিনি জীবিত নাকি মৃত, সেটা আমি বুঝতে পারিনি। আমি আন্টির বাসায় চলে আসি। তখন আমরা দুজন কান্না করতে থাকি। আমার শাশুড়ি আরেক রুমে ছিলেন, তিনিও কিছুই জানতেন না। আমিও কিছু বলিনি। উনি অসুস্থ মানুষ, এসব শুনে যদি আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন সেজন্য বলিনি।
আনারকলির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পিবিআই পরিদর্শক ইলিয়াস খাঁন বলেন, লাশ কাটার জন্য ধামা, প্লাস্টিকের ব্যাগ ও কসটেপ কিনে এনেছিল আনারকলি। যে ট্রলিব্যাগে লাশের আট টুকরো পাওয়া গেছে, সেটাও আনারকলির। কিন্তু সে দাবি করেছে, হাসানকে খুন এবং লাশ কেটে টুকরো করার ঘটনা সে দেখেনি।
সাংবাদিকদের আনারকলি বলেন, আমার স্বামী সফিকুরের কথা মতো আমি সব জোগান দিয়েছি। আমি কী করব! আমার আগের সংসার ভেঙে গেছে। এই সংসারেও যদি কোনো ঝামেলা হয়, সবাই আমাকে দোষারোপ করত, সেজন্য আমি চুপ ছিলাম। আমি পরিস্থিতির শিকার। আমি সফিকুরকে বলেছি, আমি তোমার ভালোবাসার টানে, আবেগের টানে তুমি যা বলছ তা করেছি, কিন্তু বিবেকের কাছে আমি তোমাকে সাহায্য করেছি, এজন্য আমি অপরাধী। আমি যদি জানতাম আমার শ্বশুরকে খুন করা হবে, তাহলে আমি আগেই উনাকে বাসা থেকে বের করে দিতাম।
এদিকে, আনারকলির স্বামী সফিকুরকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে জানিয়ে পিবিআই কর্মকর্তা ইলিয়াস বলেন, ‘মাথা পতেঙ্গায় ফেলে আনারকলি ও সফিকুর এক জায়গায় চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু সফিকুরের সঙ্গে থাকতে অপরাধবোধ ও অস্বস্তি কাজ করছিল তার। এজন্য সে পালিয়ে আনোয়ারা বড়উঠান এলাকায় এক ফুপুর বাসায় চলে যান। ফুপু ঘটনা জানতে পেরে তাকে বের করে দেন। আনারকলি তখন তার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মহেশখালীতে বাবার বাড়িতে চলে যান। সেখান থেকে আমরা তাকে গ্রেপ্তার করি।