টাকা না পেয়ে তিনজনকে গলা কেটে হত্যা করে সাগর-ইশিতা। ঢাকার আশুলিয়ায় একই পরিবারের তিনজনকে গলা কেটে হত্যার ঘটনায় এক দম্পতিকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
গ্রেপ্তাররা হলেন- কথিত কবিরাজ ও সিরিয়াল কিলার সাগর আলী এবং তার স্ত্রী ইশিতা বেগম। গত সোমবার দিবাগত রাতে গাজীপুরের শফিপুর এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে র্যাব-৪ এর একটি দল।
র্যাব বলেছে, নিহত গৃহকর্তা ও তার পরিবারের সদস্যদের ৯০ হাজার টাকা চুক্তিতে কবিরাজি চিকিৎসার কথা বলে বাসায় গিয়ে ইসবগুলের শরবতের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। এরপর একে একে তিনজনকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, নিহত মোক্তার হোসেন ও তার স্ত্রী সাহিদা বেগম আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তাদের সন্তান মেহেদী হাসান জয় স্থানীয় একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাভারের আশুলিয়া জামগড়া এলাকায় বহুতল ভবনের চতুর্থ তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে ভবনের অন্য ভাড়াটিয়ারা বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানায়। পরে ফ্ল্যাট থেকে মোক্তার, তার স্ত্রী সাহিদা ও তাদের ১২ বছরের শিশু ছেলে মেহেদীর অর্ধগলিত গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় গত রোববার আশুলিয়া থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা হয়।
র্যাব মুখপাত্র বলেন, একই পরিবারের তিনজনকে হত্যার ঘটনায় র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। গত রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৪ এর একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গাজীপুরের শফিপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা মো. সাগর আলী ও তার স্ত্রী ঈশিতা বেগমকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় হত্যাকাণ্ডের সময় মোক্তারের কাছ থেকে লুট করা আংটি। গ্রেপ্তার সাগর টাঙ্গাইলের মোবারক আলীর ছেলে।
আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তার দম্পতি র্যাবকে জানিয়েছে প্রথমে অর্থের লোভে ও পরে কাঙ্ক্ষিত অর্থ না পেয়ে ক্ষোভ থেকে তাদের হত্যা করা হয়।
ঘটনার বিবরণ দিয়ে র্যাব মুখপাত্র বলেন, গত ২৮ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার সাগর সাভার বারইপাড়া এলাকার একটা চায়ের দোকানে চা খাওয়ার সময় মোক্তারের পাশের একটি কবিরাজি ও ভেষজ ওষুধের দোকানে তার শারীরিক সমস্যার বিষয়ে চিকিৎসা নিয়ে কথা বলতে দেখেন। গ্রেপ্তার সাগর জানতে পারেন, মোক্তার ওই দোকানে ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসা বাবদ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ করেও কোনো ফলাফল পাননি।
সাগর কৌশলে মোক্তারকে ডেকে নিয়ে আলাপচারিতায় ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসার প্রতি তার আগ্রহ ও আস্থার কথা জানতে পারেন। মোক্তার তার ও তার পরিবারের বেশকিছু শারীরিক সমস্যার কথাও সাগরকে জানান।
সাগর জানায়, তার স্ত্রী একজন ভালো কবিরাজ এবং সে তার সমস্যার সমাধান করে দেবে। এমন মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে কথাবার্তার একপর্যায়ে ৯০ হাজার টাকার চুক্তি করেন। সাগর ও তার স্ত্রী পরের দিন (২৯ সেপ্টেম্বর) সকালে ওষুধসহ তার বাসায় গিয়ে চিকিৎসা করবে বলে জানান। যোগাযোগের জন্য মোক্তারকে সাগর নিজের নম্বর না দিয়ে এক আত্মীয়ের মোবাইল নম্বর দেন। বাসায় গিয়ে সাগর স্ত্রী ঈশিতাকে পুরো ঘটনা ও পরিকল্পনার কথা জানান। বিপুল অঙ্কের অর্থ পাওয়ার আশায় রাজি হন সাগরের স্ত্রী।
তারা পরিকল্পনা করেন ভুক্তভোগী মোক্তারের বাসায় গিয়ে ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসার কথা বলে তার পরিবারের সবাইকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তাদের অর্থসহ মূল্যবান সামগ্রী লুট করবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সাগর গাজীপুরের মৌচাক এলাকার একটি ফার্মেসি থেকে এক বক্স ঘুমের ওষুধ কেনেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২৯ সেপ্টেম্বর সকালে গ্রেপ্তার সাগর ও তার স্ত্রী গাজীপুরের মৌচাক থেকে মোক্তারের সঙ্গে জামগড়া মোড়ে সাক্ষাৎ শেষে বাসায় যান। সেখানে প্রাথমিক পরিচয়ের পর গ্রেপ্তার সাগরের স্ত্রী ঈশিতা তাদের সমস্যার কথা শোনেন এবং ইসবগুলের শরবতের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে তাদের ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসার ওষুধ বলে খাওয়ান। মোক্তার, তার স্ত্রী ও ছেলে ঘুমের ওষুধের প্রভাবে ঘুমিয়ে পড়লে সাগর ও তার স্ত্রী মিলে প্রথমে মোক্তারের কক্ষে গিয়ে মোক্তারের হাত ও পা বাঁধেন, পরে মোক্তারের স্ত্রীর হাত-পা বাঁধেন।
পরে স্বামী-স্ত্রী মিলে মোক্তারের মানিব্যাগ, তার স্ত্রীর পার্স ও বাসার অন্য স্থানে অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রীর জন্য তল্লাশি করে মাত্র ৫ হাজার টাকা পায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বঁটি দিয়ে প্রথমে মোক্তারের গলায় উপর্যুপরি কুপিয়ে হত্যা করেন সাগর। পরে অন্য কক্ষে গিয়ে ছেলে ও স্ত্রীকে একই বঁটি দিয়ে পর্যায়ক্রমে কুপিয়ে হত্যা করে। পালানোর আগে তারা মোক্তারের হাতে থাকা আংটি খুলে নিয়ে যায়।
এরপর গ্রেপ্তার দম্পতি ভিন্ন পথে রিকশাযোগে গাজীপুরের মৌচাকে তার শ্বশুরবাড়ি যান এবং সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রচারের পর তারা আত্মগোপনে চলে যান।