আজ পালিত হচ্ছে শিক্ষক দিবস

অন্তর্দ্বন্দ্বে শিক্ষাঙ্গনে বাড়ছে বিশৃঙ্খলা

প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

দেশে অন্যান্য দিবসের মতোই আজ ৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবস পালন করতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। দিবসটি উপলক্ষ্যে সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‌্যালি ও সেমিনারের আয়োজন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনার আলোকে দায়িত্ব পালন করেন শিক্ষকরা। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, হয়রানি ও শিক্ষা ক্যাডারের বৈষম্যে শিক্ষাঙ্গনে বিশৃঙ্খলা বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষক দিবস পালন করা উপলক্ষ্যে গত ২৫ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সেবা শাখার সহকারী সচিব মো. মনিরুল ইসলাম মিলনের স্বাক্ষর করা আদেশ বলা হয়েছে- শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থী ও সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে যাতে সম্মান-শ্রদ্ধাবোধ বাড়ে, সেজন্য র‌্যালি-সভা-সেমিনার থেকে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করতে হবে। নির্দেশনায় বলা হয়- শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও অংশীজনদের সাবেক ও কর্মরত শিক্ষকদের নিয়ে র‌্যালি, আলোচনা সভা ও সেমিনারের আয়োজন করতে হবে। এতে বলা হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজ উদ্যোগে শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের ভূমিকা এবং শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীসহ সবার শ্রদ্ধাবোধ এবং সম্মান বৃদ্ধির জন্য সচেতনতা তৈরিতে সাবেক এবং বর্তমান শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ অংশীজনদের অংশগ্রহণে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখে র‌্যালি, আলোচনা সভা, সেমিনারের ব্যবস্থা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জানা গেছে, হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার মুরাদপুর এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তির হস্তক্ষেপে গত ৭ বছর ধরে স্কুলের বারান্দায়ও যেতে পারছেন না। বছরের পর বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও উপজেলা শিক্ষা অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। জাকির হোসেন ছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্র করে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা ও শিক্ষকদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বে প্রতিনিয়ত হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছেন শিক্ষকরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মুরাদপুর এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হয়েছে কয়েক বছর আগে। ওই স্কুলে ১২ শিক্ষকের মধ্যে ১১ জনের চাকরি এমপিওভুক্ত হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালী নেতার কারণে স্কুলটির প্রধান শিক্ষকের চাকরিটি এমপিওভুক্ত হয়নি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তা তদন্ত করে সত্যতা পায়নি সিলেট শিক্ষা বোর্ড। জাকির হোসেনকে পুনর্বহালের নির্দেশ দিলেও তাকে বিদ্যালয়ে যোগদান করতে দেওয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে জাকির হোসেন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত স্কুল পরিচালিত হচ্ছিল। ওই সময়ে বেতন পেয়েছি। তবে এমপিওভুক্ত হওয়ার পর স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতার চোখে পড়ে স্কুলটি। নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অনিয়মের আশ্রয় নেন ওই নেতা। সেই অনিয়মের বিরোধিতা করায় আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সারাদেশে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষকদের হয়রানি বন্ধের পাশাপাশি শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারাও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। শিক্ষা ক্যাডারের তফসিলভুক্ত পদে বহির্ভূতদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় জনবলের ব্যাপক ঘাটতি আছে। আগের তুলনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে, শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে, সিলেবাস ও কোর্সের পরিধি বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু সে তুলনায় পদ সৃজন হয়নি।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির তথ্য মতে, বর্তমান শিক্ষা ক্যাডার নিয়ন্ত্রিত সরকারি কলেজসমূহে উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা স্তরে প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষকের পদ সুজন অপরিহার্য। অথচ সরকারি কলেজসহ শিক্ষা প্রশাসনে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তার সংখ্যা মাত্র ১৬ হাজার। শিক্ষার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাতে ১২ হাজার ৪৪৪টি পদ সৃজনের প্রস্তাব আটকে আছে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে।

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের অন্যতম বৃহৎ ক্যাডার সাধারণ শিক্ষা সমিতির মহাসচিব মো. শওকত হোসেন মোল্যা বলেন, শিক্ষা ক্যাডার আবারও সংকটে পড়েছে। সেজন্য বাংলাদেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা সুরক্ষায় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি বিভিন্ন সাংগঠনিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন, সুপার নিউমারারি পদে পদোন্নতি, অধ্যাপক পদ তৃতীয় গ্রেডে উন্নীতকরণ, অর্জিত ছুটি প্রদান এবং ক্যাডার কম্পোজিশনের সুরক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা নিয়োগবিধি বাতিল, শিক্ষা ক্যাডার তফসিলভুক্ত পদ থেকে শিক্ষা ক্যাডার বহির্ভূতদের প্রত্যাহার ও প্রয়োজনীয় পদসৃজনের দাবি জানানো হয়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য শিক্ষা ক্যাডার সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ দিনেও শিক্ষা ক্যাডারকে বিশেষায়িত পেশা হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। বরঞ্চ আর বৈষম্যের মাধ্যমে এ পেশার কার্যক্রমকে সংকুচিত করা হয়েছে। এ পেশাকে গ্রাস করছে অদক্ষ অপেশাদাররা। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষাস্তর সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের নবম গ্রেডের উপরে সকল পদ শিক্ষা ক্যাডারের তফসিলভুক্ত। এসব পদে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা বাদে অন্য কারও পদায়নের সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন ধরে আমরা শিক্ষা ক্যাডারের তফসিলভুক্ত পদ থেকে শিক্ষা ক্যাডার বহির্ভূতদের অপসারণের দাবি জনিয়ে আসছি কিন্তু সেটি করা হয়নি। সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের তফসিলভুক্ত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ৫১২টি পদ শিক্ষা ক্যাডারের তফসিল বহির্ভূত করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়োগবিধি চূড়ান্ত করা হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে নিয়োগবিধি করা হয়েছে। এটি সুস্পষ্টতই শিক্ষা ক্যাডারের অস্তিত্বের ওপর আঘাত।

মহাসচিব আরো বলেন, এই মুহূর্তে শিক্ষা ক্যাডারে বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তার সংখ্যা ৭ হাজারের বেশি। ক্যাডার সার্ভিসে শূন্যপদ না থাকলে পদোন্নতি দেখা যাবে না, এমন কোনো বিধান নেই। অথচ, শিক্ষা ক্যাডারকে শূন্য পদের অজুহাতে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বৈষম্য নিরসনে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি প্রদানের বিষয়ে নির্দেশনা দিলেও তা পালিত হয়নি। আমরা যোগ্য সব কর্মকর্তার পদোন্নতি প্রদানের জন্য বারবার মন্ত্রণালয়ে দাবি জানিয়েছি। কিন্তু বিভিন্ন টালবাহানা করে সময় ক্ষেপণ করা হয়েছে। ১৬তম ব্যাচের অনেক কর্মকর্তা অধ্যাপক না হয়েই অবসরে যাচ্ছেন। অন্য ক্যাডারের মতো শিক্ষা ক্যাডারে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি অনুসরণ না হওয়ায় অন্যান্য ক্যাডারের তুলনায় শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা পিছিয়ে আছেন। বেতন স্কেল অনুযায়ী চতুর্থ ও ষষ্ঠ গ্রেড প্রাপ্য কর্মকর্তাদের প্রস্তাব এক বছর আগে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়েও কোনো অগ্রগতি হয়নি।

বিষয়টি নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান এর সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।