৩১৩ জনের কাছ থেকে মুচলেকা আদায়

ঢাবির কার্জন হলকেন্দ্রিক অশ্লীলতা বন্ধে চলছে নিয়মিত অভিযান

প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  লিটন ইসলাম, ঢাবি প্রতিনিধি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বহিরাগত থেকে শুরু করে সবার পছন্দের একটি জায়গা হলো কার্জন হল এলাকা। ব্রিটিশদের তৈরি এখানকার লাল রঙের ভবন ও তার নান্দনিক সৌন্দর্য দেখতে সন্ধ্যা নামলেই বেড়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবারের সদস্যদের আনাগোনা। তিন-চার মাস আগেও এ এলাকায় বহিরাগতদের প্রবেশে ছিল না তেমন কড়াকড়ি নির্দেশনা। এতে করে সূর্যের আলো নেভার সাথে সাথে বেড়ে যেত বহিরাগত কপোত-কপোতিদের ভিড়। তারা সেখানে থাকা অবস্থায় শালীনতা বজায় রাখত না। এতে অস্বস্তিতে পড়তেন এখানে ঘুরতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। বহিরাগতদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে বাধা দিতে গিয়ে হেনস্থার শিকার হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও। তবে বর্তমানে নড়েচড়ে বসেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অশ্লীলতা বন্ধে নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। চালানো হচ্ছে নিয়মিত অভিযান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস সূত্রে জানা যায়, গত জুন মাস থেকে কার্জন হল এলাকায় নিয়মিত অভিযান চালিয়ে আসছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল টিম। গত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চলা এসব অভিযানে ৩১৩ জনকে ‘আপত্তিকর’ অবস্থায় আটক করা হয়। পরবর্তীতে যাতে কার্জন হল এলাকায় আর না আসে- এই শর্তে মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয় প্রক্টরিয়াল টিম। প্রক্টর অফিস জানায়, আটক যুগলদের বেশিরভাগই স্কুল ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী, যারা কার্জন হল এলাকাকে নিরাপদ ভেবে এখানে ঘুরতে আসে।

কার্জন হল এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ড. মো. হাসান ফারুক জানান, আগে এসব জায়গায় বহিরাগতদের আনাগোনা ছিল। তখন লাইটিংয়ের ব্যবস্থাও ছিল অপ্রতুল। গত জুন মাস থেকে আমরা রাত ৭টা থেকে ৮টার দিকে সপ্তাহে তিন-চার দিন অভিযান পরিচালনা করছি। এতে করে এসব অশ্লীল কার্যক্রম এখন অনেকটাই কমে আসছে। সরেজমিন কার্জন হল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বহিরাগত প্রবেশ বন্ধে মূল গেইটের মাঝে একটি পকেট গেইট বানানো হয়েছে। এতে করে যে কেউ আর গাড়ি কিংবা নির্বিঘ্নে সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন না। ভেতরে ঢুকতে হলে গেটের দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে পরিচয় জানাতে হচ্ছে। এছাড়া, মূল গেটের পাশে টানানো হয়েছে সতর্কতামূলক নোটিশ বোর্ড। যেখানে লেখা আছে- ‘এলাকাটি সিসি টিভি ক্যামেরার আওতাধীন। কার্জন হল এলাকায় বহিরাগত ও সাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রিত ও অবস্থান সম্পূর্ণ নিষেধ; অ্যাকাডেমিক ভবনে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ছাড়া অবস্থান করা নিষেধ; বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকার সম্বলিত যানবাহন ছাড়া অন্যান্য যানবাহনের প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত।’

ভেতরে প্রবেশ করেই চোখে পড়ে যেসব জায়গায় যুগলরা বেশি আপত্তিকর অবস্থায় অবস্থান করে, সেসব জায়গায় নতুন করে লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাস্তার পাশে, ভবনের সামনে বিভিন্ন জায়গায় লাগানো হয়েছে সতর্কতামূলক নোটিশ বোর্ড। যেখানে লেখা- ‘এলাকাটি সিসি টিভি ক্যামেরার আওতাধীন। অ্যাকাডেমিক ভবনে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ছাড়া অবস্থান করা নিষেধ।’ নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার ও অশ্লীলতা বন্ধে সিসি টিভি ক্যামেরা বৃদ্ধির কাজ অব্যাহত রয়েছে বলে জানান সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক হাসান।

তিনি বলেন, ‘পুরো কার্জন এলাকায় এখন পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সাথে সিসি ক্যামেরা বাড়ানোর কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আমাদের নিয়মিত অভিযানে যাদের আটক করেছি, তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে; যাতে পরবর্তীতে আর এখানে না আসে। অনেকের অভিভাবককে ডেকে এনে এসব বিষয় জানানো হয়েছে। এতে করে যারা একবার মুচলেকা দিয়েছে তারা আর পরবর্তীতে কখনো আসেননি।’

কার্জন হলের সাথেই রয়েছে বিজ্ঞান বিভাগের ছেলে শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল ও ড. ফজলুল হক মুসলিম হল। এই এলাকার পর্যাপ্ত আলোক সজ্জায় পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. একেএম মাহবুব হাসান। তিনি বলেন, বহিরাগতরা যাতে না আসে এবং সামাজিক পরিবেশ উন্নয়নের জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সেজন্য লাইটিং, সতর্ক বাণী, মূল গেটে পকেট গেট করে দিয়েছি। প্রক্টরিয়াল টিম নিয়মিত টহল দিচ্ছে। আগের থেকে পরিবেশ অনেক ভালো। তবে এটা বজায় রাখতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা অনেক জরুরি।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এরকম উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ সমুন্নত রাখতে বহিরাগতদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে কার্জন হল এলাকায় আগে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে যে অস্বস্তিতে পড়তে হতো, তা এখন অনেকটাই কমে এসেছে। এখন এই ধারা অব্যাহত থাকার দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রওশন আলী বলেন, কিছুদিন আগেও কার্জন হল এলাকায় ঘুরতে যাওয়া ছিল অনেক কষ্টকর। আশপাশের বারান্দায় তাকালেই নানা আপত্তিকর দৃশ্য চোখে পড়ত। পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা ছিল অসম্ভব। কিন্তু প্রক্টরিয়াল টিম সম্প্রতি তাদের কর্মতৎপরতা বাড়ানোয় পরিবেশ কিছুটা অনুকূলে এসেছে। তাদের কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ আরো প্রশান্তিদায়ক হবে। অভিযানের ধারা অব্যাহত থাকবে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদুর রহমান। তিনি আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার জন্য যেকোনো কিছুই হোক এগুলোকে একেক করে আমরা সমাধান করার চেষ্টা করতেছি। আমরা এটা (অভিযান কার্যক্রম) আজকে করলাম এরকম না; এর ধারা অব্যাহত থাকবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন জায়গায় বসবে, আড্ডা দেবে, মতবিনিময় করবে- এগুলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু কোনো বহিরাগত এখানে এসে সামাজিক অপরাধমূলক কাজকর্ম করবে, বিশ্ববিদ্যালয় কোনোভাবেই তা সমর্থন করে না। এসব বন্ধে আমরা বিভিন্ন জায়গায় সতর্কতামূলক নোটিশ লাগিয়েছি। সেই সাথে লাইটিং বাড়ানো হয়েছে।