কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যৌথ অভিযান জোরদারের পরও থামছে না অপরাধ প্রবণতা। অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারে হচ্ছে রক্তপাত, বাড়ছে সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা, মাদকের বেচা-কেনা।
চলতি বছরের গত সোমবার পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ৬৬ জন। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মো. রফিকুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, গত সোমবার পৃথক দুইজন খুনসহ ৬৬ জন খুন হয়েছে। খুনের ঘটনায় এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৫৬টি। যার মধ্যে উখিয়ায় ৫০টি ও টেকনাফে ৬টি মামলা লিপিবদ্ধ হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার রয়েছে কমপক্ষে ৭০ জনের বেশি। পুলিশ এসব মামলা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে এমন পরিস্থিতিতে ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কার্যক্রম, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও মাদক রোধে জোরদার করা হয়েছে যৌথ অভিযান। এতে গত রোববার মধ্যরাতে টেকনাফের উনচিপ্রাং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড়ের পাশে এ অভিযান চালিয়ে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদি সংগঠন ‘রোহিঙ্গা সলিডারিটি আরগানাইজেশন (আরএসও)’ এর ৩ সদস্যকে অস্ত্র ও গুলিসহ আটক করা হয়েছে। ক্যাম্পে নিরাপত্তায় নিয়োজিত এপিবিএন বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ টহলের পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে চেকপোস্ট ও গোয়েন্দা নজরদারি।
এর আগে চলতি মাসের ৪ অক্টোবর আরেকটি জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে ক্যাম্পে। উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র সংগঠন আরসা ও আরএসও’র মধ্যে সংঘর্ষে এ দুইজন নিহত হয়েছে।
ক্যাম্পজুড়ে যৌথ অভিযান জোরদার : রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অপরাধ প্রবণতা রোধে এরইমধ্যে যৌথ অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অভিযানের অংশ হিসেবে গত রোববার মধ্য রাতে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদি সংগঠন ‘রোহিঙ্গা সলিডারিটি আরগানাইজেশন (আরএসও)’ এর তিন সদস্যকে অস্ত্র ও গুলিসহ আটক করেছে এপিবিএন পুলিশ।
টেকনাফের উনচিপ্রাং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড়ের পাশে এ অভিযান চালানো হয় বলে জানিয়েছেন ১৬ এপিবিএনের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ হাসান বারী নূর। আটকরা হলেন, ওই ক্যাম্পের মনির আহমেদের ছেলে কামাল হোসেন (২৭), আবদুর শুক্কুরের ছেলে অজিউর রহমান (১৮), তাজিমুল্লার ছেলে মুজিবুর (১৮)। উদ্ধার করা হয়েছে তিনটি দেশীয় তৈরি ওয়ান শুটারগান বন্ধুক (এলজি) ও ১৪৬ রাউন্ড তাজা গুলি।
১৬ এপিবিএনের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ হাসান বারী নূর জানিয়েছেন, গোপন সংবাদের ভিওিতে উনচিপ্রাং ক্যাম্পের সি/৫ ব্লকের পাহাড়ের ঢালে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে অস্ত্র ও গুলিসহ তিনজন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। আটকরা স্বীকার করেছে তারা আরএসও নামের রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদি সংগঠনের সদস্য।
এবিপিএনের তথ্য বলছে, চলমান অভিযানে একমাসে হত্যা, অপহরণ, মাদক, অস্ত্র ও অন্যন্যা মামলায় শতাধিক আসামি গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয় অস্ত্র, গুলি ও ইয়াবা।
ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে এপিবিএনের সঙ্গে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, আনসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মিলে পরিচালিত হচ্ছে এসব যৌথ অভিযান।
৮ এপিবিএনের সহ-অধিনায়ক খন্দকার ফজলে রাব্বী বলেন, অভিযানে প্রথমে ক্যাম্প নির্ধারণ করা হয়। এরপর ওই ক্যাম্পের ব্লকগুলো যেখানে অস্ত্রধারি বা দুষ্কৃতকারিরা থাকতে পারে সেসব ব্লকগুলো চারিদিকে ঘিরে ফেলা হয়। তারপর ব্লকে ব্লকে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে ১০০ এপিবিএন সদস্য, ২ প্লাটুন বিজিবি, ২৫ জন র্যাব সদস্য, ২৫ জন পুলিশ সদস্য ও ২৫ জন আনসার সদস্য নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন।
জামতলী ক্যাম্প ডি-২ এর বাসিন্দা হাকিম বলেন, ক্যাম্পে যে খুনোখুনি, গোলাগুলি ও সংঘর্ষ চলছে এগুলো আমরা চাই না। ক্যাম্পে এসব অস্থিরতা বন্ধ হোক। যতদিন নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে না যাচ্ছি, ততদিন যেন ক্যাম্পে শান্তিতে বসবাস করতে পারি। এই নিরাপত্তা আমরা দাবি করছি। এজন্য যৌথ অভিযানকে স্বাগত জানান তিনি।
আরেক রোহিঙ্গা আবদুর রহমান বলেন, ক্যাম্পকে নিরাপদ করতে প্রশাসন সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করুক এটা আমাদের দাবি। এখন প্রশাসনের টহল ও অভিযান বেড়েছে, এতে অনেক অপরাধী পালিয়েছে। আমরা চাই, ক্যাম্পে একটু শান্তিতে বসবাস করতে।
যৌথ অভিযানে থাকা টেকনাফস্থ র্যাব-১৫ সিপিসি-১ এর স্কোয়াড্রন কমান্ডার এএসপি মাহতাব বলেন, যৌথ অভিযানের মূল উদ্দেশ্যে হলো মাদক ও অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ঠেকানো। যেসব তথ্য পাচ্ছি সেসব তথ্যের ভিত্তিতে আমরা সব বাহিনীর সমন্বয়ে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি এবং যাব। বিশেষ করে, আরসাসহ অন্যন্যা সন্ত্রাসীগুলো থেকে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মুক্তি ও স্বস্তি দিতে কাজ করে যাচ্ছি।
উখিয়াস্থ ৮ এপিবিএনের অধিনায়ক মো. আমির জাফর বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হবার কারণে ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মাঝে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই অস্থিরতা রোধ এবং অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য যৌথ অভিযান জোরদার করা হয়েছে। যৌথ অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে দুষ্কৃতকারিরা আইনের আওতায় আসলে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মাঝে স্বস্তি ফিরবে।
মো. আমির জাফর বলেন, প্রতিদিনই এপিবিএন সদস্যরা নিজেদের মতো করে অভিযান পরিচালনা করছে। আর কিছুদিন পরপর বা এক সপ্তাহে দুই দিন করে এপিবিএন, জেলা পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে নিয়ে যৌথ অভিযান পরিচালনা করছি।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ২৩ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) কক্সবাজার ব্যাটালিয়ন (৩৪ বিজিবি) এর অধীনস্থ সীমান্তবর্তী উখিয়ার পালংখালী বিওপির আওতাধীন জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্প-১৭ এর এ ব্লকে অবস্থিত আরসিও কার্যালয়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে পালানোর বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা হিসেবে সব পয়েন্টে চেকপোস্ট স্থাপন, প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও অনুপ্রবেশ ঠেকানোসহ ১২ সিদ্ধান্ত হয়। সভায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ কর্মকাণ্ড নিয়ে ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার পূর্বক জেলে পাঠানোর পর আদালত কর্তৃক জামিনে মুক্তি পাওয়া, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবিধির সঙ্গে সমন্বয় করা, নিয়মিত পুলিশ টহল ও বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা, মাঝিদের কার্যক্রম বৃদ্ধি ও তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড নজরদারি রাখা, সাধারণ রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে যাতে যেতে না পারে এজন্য চেকপোস্ট বৃদ্ধি করা ও প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা, সীমান্ত উত্তেজনায় যাতে অনুপ্রবেশ ঠেকানোসহ গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা, স্থানীয় দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে আরসা সন্ত্রাসীদের যোগাযোগ, জিরো পয়েন্টে আরসা সন্ত্রাসীদের অবস্থানসহ বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা করা হয়।