কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের জমি অধিগ্রহণ শাখা বা এলএ শাখা নিয়ে যেন ভুক্তভোগীদের অভিযোগের পাহাড়। কক্সবাজার জেলা জুড়ে সরকারের চলমান মেগা প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ হওয়ার পর সেই টাকা আদায় করতে গিয়ে যেন পথে পথে হয়রানি ও ভোগান্তির শেষ নেই। এখানে কার জমির টাকা কে তুলে নিয়ে গেল তারও সঠিক ব্যাখ্যা নেই। এমন কী ক্ষেত্রবিশেষে মৃত ব্যক্তির ক্ষমতাবলে আমমোক্তারনামায়ও নিয়ে যাওয়া হয়েছে অধিগ্রহণের টাকা। অথচ ওই ব্যক্তির মারা যাওয়ার পরই স্বাক্ষর করেছেন আমমোক্তারনামায়।
গতকাল বুধবার কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত দুর্নীতি দমন কমিশন আয়োজিত গণশুনানিতে উপস্থাপিত হয়েছে এসব তথ্য।
সকাল ১০টায় কক্সবাজার পাবলিক লাইব্রেরির শহীদ সুভাষ হলে অনুষ্ঠিত হয়েছে এই গণশুনানি। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গণশুনানির আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহিরুল হক বলেন, আমাদের দেশটা খুব বেশি উদ্ভট। এখানে অশিক্ষিত মানুষগুলো বিদেশ গিয়ে অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে বিদেশ থেকে দেশে টাকা পাঠান। আমাদের রেমিটেন্স বাড়ে। আর শিক্ষিত মানুষ দেশের টাকা লুট করে বিদেশে টাকা পাচার করেন। যে টাকা জমা হয় সুইস ব্যাংকে। যে ব্যাংকে এসব টাকা জমানো হচ্ছে, ওই ব্যক্তির মৃত্যুর পর এই টাকা কোনো কাজেই আসবে না। কেন না ব্যক্তির মৃত্যুর পর সেই টাকার বৈধ আয়ের উৎস ওয়ারিশরা দিতে না পারলে সুইস ব্যাংক টাকা ফেরত দেবে না। এসব শিক্ষিত দুর্নীতিবাজদের প্রকাশ্যে ঘৃণা করার আহ্বান জানান তিনি।
তিনি বলেন, সব দুর্নীতি নিয়ে দুদক কাজ করে না। দুদক যেসব অভিযোগ আমলে নিয়ে কাজ করে, তার বেশির ভাগই সরকারি প্রতিষ্ঠান ঘিরে। এর বাইরে মানিলন্ডারিং বিষয়ে কাজ করে। অপরাপর অপরাধের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা কাজ করে। দুদক আমলে নেয়া মামলায় এ পর্যন্ত দুর্নীতির ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ ও মানি লন্ডারিং এর ক্ষেত্রে শত ভাগ সফলতা পেয়েছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দুদক মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আকতার হোসেন, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম. দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন বকুল বক্তব্য দেন। এর পরই শুরু হয় জমা হওয়া ৬৯টি অভিযোগের বিষয়ে গণশুনানি। যেখানে মঞ্চ উঠে ভুক্তভোগী উপস্থাপন করেন হয়রানি, অনিয়ম, দুর্নীতির নানা অভিযোগ। আর একই মঞ্চে বসে এসব অভিযোগের উত্তর দেন অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। উভয় পক্ষের বক্তব্যের পর ছিল দুদকের নিজস্ব মতামতও। শুনানিতে উপস্থাপিত অভিযোগের অধিকাংশ সময়জুড়ে ছিল কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ বা এলএ শাখা ঘিরে।
যেখানে কক্সবাজার শহরের কলাতলী এলাকার আমিন নামের এক প্রবাসির স্ত্রী মুন্নী আকতার বলেন, সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে জায়গা কিনি আমি। অথচ জমি অধিগ্রহণ হওয়ার ওই জমির তথ্য দিয়ে টাকা উত্তোলন করে নিয়ে গেছে ইদ্রিস নামের এক ব্যক্তি। অভিযোগকারী মুন্নীর কাগজপত্র দেখে দুদক কমিশনার জহিরুল হক বলেন, এই জমির দুইজন ক্রেতা। একজন আমিন ও অপরজন ইদ্রিস। আমিন এই জমির প্রথম ক্রেতা। প্রথমজন টাকা পেলেন না আর দ্বিতীয় জন পেলেন! এটা কীভাবে সম্ভব, তা দ্রুত সমাধানের জন্য নির্দেশ দেন তিনি। অভিযোগকারীকে বৃহস্পতিবার (আজ) কাগজপত্র দিয়ে দেখা করতে বলেন জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান। শুনানিতে মহেশখালীর মাতারবাড়ী এলাকার বেলাল হোসেন জানান, কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রে তার বাবার সম্পত্তির টাকার জন্য ফাইল জমা দেয়। অনেক শুনানিতে অংশগ্রহণ করে আশ্বাস দিয়েছিলেন টাকা প্রদানের। ডিসি এবং এডিসিও একই আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু টাকা পাননি। এলএ শাখার কর্মকর্তা সুভাশিষ চাকমা এ সংক্রান্ত দেওয়ানি মামলা থাকায় জটিলতার কারণে টাকা প্রদান করা যাচ্ছে বলে দাবি করেন। কিন্তু অভিযোগকারী তা মানতে রাজি নন। তিনি বলেন, দেওয়ানি মামলায় পক্ষভুক্ত নন তিনি। জেলা প্রশাসক তাকে দেখা করতে বলেন। কিন্তু বেলাল দাবি করেন, তিনি জেলা প্রশাসকের কাছে গিয়েছিলেন। জেলা তাকে সার্ভেয়ারের কাছে যেতে বলেন। কিন্তু সার্ভেয়ারের কাছে যেতে বলার বিষয়টি অস্বীকার করেন জেলা প্রশাসক। জেলা প্রশাসকের দাবি, তিনি সার্ভেয়ারের কাছে যেতে বলেননি, তিনি বলেছিলেন এডিসি অথবা এলএও’র কাছে যেতে। এই সময় দুদক কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জেলা প্রশাসক স্বীকার করেন জমি অধিগ্রহণ ও টাকা প্রদানের ক্ষেত্রে কিছু কিছু দুর্নীতি হচ্ছে। ডিসি বলেন, ক্ষতিপূরণের টাকা বিতরণে স্বচ্ছতাণ্ডজবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করার প্রয়োজন, সব হচ্ছে। দুদক কমিশনার জহিরুল হক এ ব্যাপারে আরো সতর্ক হওয়ার আহ্বান করেন। শুনানিতে অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সাদ্দাম হোসেনের কাছে ৩০ শতাংশ ঘুষ দাবি এবং ঘুষ না দেওয়ায় ৫২ লাখ টাকা অপর তিনজন ব্যক্তিকে দিয়ে দেয়া।
পেকুয়ার মগনামা এলাকার নুরুল আলমকে এলএও সুভাশিষ চাকমা শুনানি করার পর সার্ভেয়ারের কাছে যেতে বলেন। কিন্তু সার্ভেয়ারের শর্ত না মানায় অপরজনকে টাকাগুলো দিয়ে দেয়ার অভিযোগ করেন। একইভাবে ঈদগাঁও’র প্রবাসী ছৈয়দ হোসেন, রামুর মাহবুবুল আলম ও মীর কাশেম মাস্টারও অভিযোগ করেন অধিগ্রহণের টাকা না পাওয়ার বিষয়ে। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে সাত দিনের মধ্যে সমাধানের নিদের্শ দেন দুদক কমিশনার। অন্যথায় দুদক নিজস্বভাবে তার তদন্ত শুরু করবেন বলে জানান। শুনানিতে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে মেডিকেল সনদ বাণিজ্য, সমবায় কর্মকর্তার টাকা আত্মসাৎ, পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ বাণিজ্য ও দালাল চক্রের বিষয়ে অভিযোগ উপস্থাপন হয়েছে, যা সমাধানের নিদের্শও দেয়া হয়। পাসপোর্ট অফিস কর্মকর্তাকে উদ্দেশ করে দুদক কর্মকর্তা বলেন, কিছু রোহিঙ্গা পাসপোর্ট পেয়ে গেছে। কিছু আবেদনকারী হয়রানির শিকার হচ্ছে। পাসপোর্ট অফিসের হয়রানি নতুন নয়। সব পাসপোর্ট অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্য থাকে। আপনার আত্মীয়স্বজনের কাছে জিজ্ঞেস করেন পাসপোর্ট করতে কী পরিমাণ হয়রানি পোহাতে হয়। পাসপোর্টে সমস্যা আছে, এটা প্রমাণিত। হয়রানি করা যাবে না।