বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

নদী বাঁচাতে পানিপ্রবাহের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ

প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের নদীগুলোকে মানবদেহের সঙ্গে তুলনা করে এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পানির প্রবাহ যথাযথভাবে প্রবাহমান রাখতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হার্টে ব্লক তৈরি হলে মানুষ মারা যায়। আমাদের নদী ও খালগুলো মানুষের প্রাণের মতো। এগুলোকে প্রবাহিত রাখতে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী গতকাল সকালে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে পানিসম্পদ মনন্ত্রণালয়ের ৮০টি উন্নয়ন প্রকল্প ও পুনঃখননকৃত ৪৩০টি ছোট নদী-খাল-জলাশয়ের উদ্বোধন এবং নতুন অনুমোদিত ২০টি উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে ভাষণে একথা বলেন।

শেখ হাসিনা একই অনুষ্ঠান থেকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন দেশের প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ‘কমিউনিটি আই সেন্টার স্থাপন’ কার্যক্রমের চতুর্থ পর্যায়ে ৬৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থাপিত কমিউনিটি আই সেন্টারের উদ্বোধন করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশ নদীমাতৃক, নদীই আমাদের জীবন। এগুলো ঠিক শরীরের ধমনি-শিরা-উপশিরার মতো।

তিনি উদাহরণ দেন হার্টের ধমনি ব্লক হলে রক্ত যেমন সঞ্চালন হতে না পেরে মানুষ মারা যায়। আমাদের দেশের নদী-নালাও আমাদের জীবনের মতোই। তাদের সচল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। নদীপ্রবাহ যেন অব্যাহত থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমাদের প্রতিটি প্রকল্প গ্রহণ ও সম্পন্ন করতে হবে।

এজন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বা উন্নয়নের নাম করে কিন্তু সমস্ত খাল, বিল, নদী-নালা, পুকুর পর্যন্ত ভরাট করে ফেলা হয়। আমি মনে করি এটা অত্যন্ত গর্হিত একটি কাজ। তিনি বলেন, আমাদের দেশে যখনই যে প্রকল্প নেওয়া হবে অবশ্যই এই পানি সম্পদকে রক্ষা করার ব্যবস্থা সেখানে সবাইকে নিতে হবে। আমি তা-ই চাই।

যে কারণে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকে নদীগুলো ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নেয় এমনকি ’৭৫ এ জাতির পিতাকে হত্যার পর ৬ বছর প্রবাস জীবন কাটাতে বাধ্য হয়ে ’৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে জোর করে দেশে ফিরে আসার পর থেকেই তিনি নদী ড্রেজিয়ের দাবি তোলেন বলেও জানান। কিন্তু অনেকেই তাকে সে সময়ে সমর্থন করতে পারেনি, নদীর পাড় বাঁধানোর দিকেই নজর ছিল।

সরকারপ্রধান বলেন, ‘শুধু পাড় বাঁধিয়েই হবে না। তাহলে তো নদী ভরাট হয়ে যাবে। বাংলাদেশ একটা ব-দ্বীপ, পলিদ্বারা সৃষ্ট। আমরা সরকারে এসেই জাতির পিতার পদাংক অনুসরণ করেই প্রতিটি এলাকায় নদী, খাল, বিল, পুকুর, জলাধার, হাওর, বাঁওড় যা কিছু আছে, সেগুলোতে যেন পানিপ্রবাহ সচল থাকে, সেই সাথে খালগুলোর সঙ্গে নদীর সংযোগ খনন ও পুনঃখননের উদ্যোগ গ্রহণ করি। যখনই আমরা সরকারে এসেছি নদী মাতৃক এই দেশে নদীর সংযোগগুলো সচল করারও উদ্যোগ নিই।’

যশোরের শার্শা উপজেলা, পাবনার সাঁথিয়া উপজেলা এবং মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিল। তিনি উপস্থিত স্থানীয়দের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

প্রধানমন্ত্রী গত ১৫ বছরে বাস্তবায়িত উন্নয়ন পরিকল্পনা সমন্বিত ‘জয়যাত্রা’ নামে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।

অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক।

অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের ওপর দুটি পৃথক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।

শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার ২০১৮ সালে বাংলাদেশ

ব-দ্বীপ উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, যা পরবর্তীতে ২১০০ সাল পর্যন্ত এই বদ্বীপকে ধরে রাখা এবং উন্নত করার জন্য ‘ডেল্টাপ্ল্যান-২১০০’ এ রূপান্তর করা হয়।

আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও পণ্য পরিবহণ সবচেয়ে সুলভে হয় নৌ-পথে। যে কারণে একে সচল রাখায় তার সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপেরও উল্লেখ করেন তিনি।

সরকারপ্রধান বলেন, গত ১৪ বছরের বেশি সময় দেশ পরিচালনায় তার সরকার ৯৯০ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ করেছে। ১ হাজার ৫৪৪ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ১০ হাজার ৫৭১ কিলোমিটার বাঁধ মেরামত করায় ৩১টি জেলাকে নদীভাঙনের হাত থেকে সুরক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। ৫ হাজার ৩০০ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং করা হয়েছে। ড্রেজিংকৃত মাটি যত্রতত্র না ফেলে তার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে ১ হাজার ০৮৬ বর্গ কিলোমিটার ভূমি পুনঃরুদ্ধার করতে পেরেছে, যেটা আমাদের অর্থনৈতিক কাজে ব্যবহার হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সাল থেকে এই ২০২৩ সাল পর্যন্ত তার সরকার পানিসম্পদ উন্নয়ন খাতে ৯৭০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। দেশব্যাপী ৫ হাজার ৮১১ ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, যখন কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয় রাস্তা-ঘাট, রেললাইন, স্থাপনা যাই করা হোক, সেখানে যেন কোনোভাবেই পানিপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত না হয়। কালভার্ট বা ব্রিজ করে দেয়ার জন্য তার নির্দেশনা রয়েছে। অথবা বন্যার সময় রাস্তা ভেঙে গেলে যে জায়গাটা ভেঙে যাচ্ছে, সেখানে আর মাটি ভরাট না করে কালভার্ট বা ব্রিজ করে দেয়ারও নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে, যেন পরবর্তিতে বানের পানি সঠিকভাবে নেমে যেতে পারে।

তিনি বলেন, কাজেই আমাদের দেশে যে কোনো পরিকল্পনা করার সময় এসব বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সেভাবেই পরিকল্পনা নিতে হবে। তাছাড়া জলাবদ্ধতা যেন সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। এজন্য প্রতিটি প্রকল্পের সঙ্গে অন্তত একটি জলাধার রাখতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার ৪১ সেট ড্রেজার ক্রয় করেছে, যা ব্যবহার করে ৫ হাজার ৩৫৫ কিলোমিটার নতুন সেচ খাল খনন ও ১ হাজার ৯৪২ সেচখাল পুনঃখনন করেছে এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় বন্যার আগাম সতর্ক বার্তা মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে জনগণকে প্রেরণের উদ্যোগ নিয়েছে।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার পানি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একবার ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পর প্রতি বছর মেনটেইনেন্স ড্রেজিং করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত অভিঘাত মোকাবিলা করার জন্য আমাদের যে প্রস্তুতি, তার অংশ হিসেবেই এগুলো করা হচ্ছে এবং গৃহহীনদের মধ্যে বিনামূল্যে ঘর বিতরণকালে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় দুর্যোগ সহনীয় ঘরবাড়ি নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে।

শেখ হাসিনা বলেন, প্রকৃতিকে তার আপন খেয়ালে চলতে দিতে হবে এবং এরই মধ্যে আমাদের সম্পদ রক্ষারও ব্যবস্থা নিতে হবে।

৯৮ শতাংশ মানুষকে সুপেয় পানির সুবিধা প্রদানের আওতায় আনার মাধ্যমে এসডিজির একটি লক্ষ্য সরকার বাস্তবায়ন করছে উল্লেখ করে তিনি জলপথ পরিচ্ছন্ন্ রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। চলাচলের সময় জলপথে বা নদীতে এমনকি সড়ক-মহাসড়কে বর্জ্য না ফেলার জন্য এবং বর্জ্য ফেলার নির্দিষ্ট স্থানে বর্জ্য ফেলে পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখার জন্যও তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। কলকারখানার দূষিত বর্জ্য জলাধার বা নদীতে না ফেলার বিষয়েও তিনি সতর্ক করেন।

যত্রতত্র যেন শিল্প কারখানা গড়ে না ওঠে, সেদিকে নজর দিয়ে তার সরকার সারাদেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, জিয়া, খালেদা জিয়া বা এরশাদ এরা কেউই এদিকে নজর দেয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পরই দূষণ প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে। আপনাদেরও খেয়াল রাখতে হবে কোনোমতেই আমাদের পানিসম্পদ যেন দূষিত না হয়।

তিনি বলেন, আমি আশাকরি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় গৃহীত প্রকল্পের মাধ্যমে পানির চাহিদাভিত্তিক অতিরিক্ত ব্যবহার ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ অর্জন করা সম্ভব। এর মাধ্যমে বর্তমানের চাহিদা মিটিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুরক্ষিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা আমরা রেখে যেতে চাই।