সাধুর হাট জমজমাট
সব পথ যেন মিশেছে কেবলই লালনধামে
প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এ.এইচ.এম. আরিফ, কুষ্টিয়া
বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের তিরোধান দিবসে ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে মানুষের ঢল নেমেছে। দাওয়াত নেই, পত্র নেই, তবুও সব পথ যেন এসে মিশে গেছে মরা কালী নদীর তীরে। কুষ্টিয়া শহর থেকে মাত্র ১০ মিনিটের রাস্তা ছেঁউড়িয়া। কিন্তু এখন সে রাস্তায় যেতে সময় লাগছে ঘণ্টার উপরে। সাধু-গুরু বাউলরা ছাড়াও সাধারণ দর্শনার্থীর ভিড়ই বেশি।
গতকাল বাউলের চারণভূমিতে আসা হাজার হাজার লালন-ভক্ত, সাধু-গুরু কর্তৃপক্ষের দেয়া সকালের অধিবাসে পায়েশ ও মুড়ির বাল্যসেবা নেন। দুপুরে তারা মরা কালীগঙ্গায় গোসল সেরে ইলিশ মাছ-ভাত ও ত্রিব্যঞ্জন দিয়ে (তিন ধরনের সবজি দিয়ে তৈরি তরকারি) দুপুরের খাবার পুণ্যসেবা গ্রহণ করেন। পুণ্যসেবা গ্রহণ কেন্দ্র করে দুপুর ১টায়, লালন একাডেমির প্রধান ফটক তখন বন্ধ। ভেতরে লাইন দিয়ে কলাপাতা সামনে নিয়ে হাজার হাজার সাধু ফকিরের অপেক্ষা। সবাই খাবার পাওয়ার পর বিশেষ আওয়াজ দিয়ে জানিয়ে দেয়া হলো বিতরণ শেষ। এবার খাওয়া শুরু হলো একযোগে। ইলিশ মাছ, ভাত ও সবজি দিয়ে প্রায় ৫ হাজার বাউল, সাধু ফকির পুণ্যসেবা গ্রহণ করেন। এছাড়া দই-মিষ্টি খাওয়ানো হয়। দাওয়াত ছাড়াই মানুষ ছুটে আসে দলে দলে, হাজারে হাজারে। কোন সে উদাসী ডাকে, তা কেউ জানে না।
মূল গেট থেকে ভেতরে ঢুকে অডিটরিয়ামের নিচে বসে প্রবীণ বাউল নহির শাহ। বয়স প্রায় ৭৯ বছর। শিষ্যদের নিয়ে গানে মজেছিলেন। এখনো আটা স্বাস্থ্য। দেখে বোঝা যায় না বয়স। গান থামালে কথা হয় এ বাউলের সাথে। গান দিয়েই শুরু করেন কথা। ‘খাচার আড়া পড়লো ধসে পাখি আর দাঁড়াবে কিসে’ ‘খাচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’। ‘এই দেশেতে এই সুখ হলো আবার কোথায় যায় না জানি’। গানের মর্ম কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন বুঝে নিতে হবে। লালন সাঁইজির মৃত্যুর পর তিরোধান দিবসে প্রতি বছরের মতো এবারও সাধক লালনের আধ্যাত্মিক দর্শন লাভের আশায় দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ প্রাণের টানে ছুটে আসেন। একতারা, দোতারা, ঢোল ও বাঁশির সুরে মুখরিত হয়ে উঠেছে লালনভূমি ছেঁউড়িয়া। একই সাথে চলছে দীক্ষা পর্ব। নব্য শিষ্যরা গুরুদের সেবা করতে উদগ্রীব। যেন কোনো কষ্ট না হয় সেদিকে তাদের অটুট লক্ষ্য। যশোর থেকে আসা নব্য বাউল ফকির আসলাম জানান, এ পথে আসা দুই মাস হয়েছে। এখনো কিছুই শিখতে পারিনি। গুরুর সাথেই থাকি দিন-রাত। তার খেদমত করাই আমার কাছ। গুরু বলেছে সময় হলে গুরু বাক্য দেয়া হবে।
বাউলসাধক ফকির লালন সাঁইজির জীবন-কর্ম, জাতহীন মানবদর্শন, মরমি সংগীত ও চিন্ত-চেতনা এখন আর এই ছেঁউড়িয়ার গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ নেই। দেশের সীমানা পেরিয়ে তা এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে। তার সংগীত ও ধর্মণ্ডদর্শন গবেষণার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে অনেক আগেই। কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. এহেতেশাম রেজা’র সভাপতিত্বে তিন দিনব্যাপী বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইজির তিরোধান দিবসের (মৃত্যুবার্ষিকী) অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধরণ সম্পাদক কুষ্টিয়া-সদর ৩ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য মাহবুব-উল-আলম হানিফ। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন কুষ্টিয়া-১ দৌলতপুর আসনের এমপি আঃ কাঃ মঃ সরওয়ার জাহান বাদশাহ্, কুষ্টিয়া-৪ খোকসা-কুমারখালী আসনের এমপি ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ, কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এএইচএম আবদুর রকিব কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ সদর উদ্দিন খান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী, জিপি অ্যাডভোকেট আখতারুজ্জামান মাসু, পিপি অ্যাডভেকেট অনুপ কুমার নন্দী, কুমারখালী পৌরসভার মেয়র শামসুজ্জামান অরুন, কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও লালন একাডেমির সাবেক সাধারণ সম্পাদক তাইজাল আলী খান প্রমুখ।
প্রধান আলোচক হিসেবে থাকছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ড. শাহিনুর রহমান। আলোচক থাকছেন লালন মাজারের প্রধান খাদেম মহম্মদ আলী। সুষ্ঠুভাবে আয়োজন সম্পন্ন করতে নেয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা। পুলিশের পাশাপাশি অনুষ্ঠানস্থলে থাকবে র্যাব ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ।
লালন সাঁইজির মৃত্যুর পর তিরোধান দিবসে আখড়াবাড়িতে ভক্ত-অনুসারীদের নিয়ে সাধুসঙ্গে সারা রাত গান-বাজনা ও নানা তত্ত্ব কথা আলোচনা করতেন। সাঁইজির দেহ ত্যাগের পরও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। সারা আখড়াবাড়ি ও মাঠই এখন গানের মঞ্চ। ছোট ছোট বাউল পরিবারেই চলছে গান। ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ ‘এই মানুষে আছে রে মন, যারে বলে মানুষ রতন, ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে, বদ হাওয়া লেগেছে পাখির গায়, বাড়ির পাশে আরশিনগর, মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই কুল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, সত্য বল সুপথে চল, এলাহি আলামিন গো আলা বাদশা আলমপনা তুমি’- এরকম অসংখ্য লালন সংগীতের সুরের মূর্ছনা রাতে লালন একাডেমির শিল্পী ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বাউলরা পরিবেশন করেন। এছাড়া লালন মাজারের আশপাশে ও মরা কালী নদীর তীর ধরে বাউলরা ছোট ছোট আস্তানা গেড়ে সাঁইজিকে স্মরণ করেছেন তার অমর বাণী পরিবেশনের মাধ্যমে। লালন উৎসবে অস্থায়ী দোকানগুলোয় উপচেপড়া ভিড়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় মেলার মাঠের স্থায়ী মঞ্চে বসে আলোচনা সভা। এরপর শুরু হয় লালন একাডেমির শিল্পীদের গান।