জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা উৎসব আজ
অগ্রযাত্রার ইতিহাস বড়ই রোমাঞ্চকর
প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
জবি প্রতিনিধি
ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির বাহক পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)। বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা জগা বাবুর পাঠশালাটি আজকের পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়। একটি পাঠশালা হিসেবে যাত্রা শুরু করে দেড় শতকের মধ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর অগ্রযাত্রার ইতিহাস বড়ই রোমাঞ্চকর। আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টির ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ২০ অক্টোবর শুক্রবার হওয়ায় একদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নতুন হলেও প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে সুদীর্ঘ দেড়শ’ বছরেরও পুরোনো ইতিহাস। বাংলদেশের ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলন এবং উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি আন্দোলনের ইতিহাসে জগন্নাথের অবদান কখনো অস্বীকার করার মতো নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস থেকে জানা যায়, তৎকালীন ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতা দীননাথ সেন, অনাথ বন্ধু মৌলিক, পার্বতী চরণ রায়, ব্রজসুন্দর মিত্র প্রমুখের প্রচেষ্টায় ১৮৫৮ সালে ‘ব্রাহ্ম স্কুল’ যাত্রা শুরু করে। ‘ব্রাহ্ম স্কুল’ প্রতিষ্ঠার এক দশকের মধ্যেই স্কুলটি ভয়াবহ রকমের আর্থিক সংকটে পড়ে। ফলে স্কুলটি টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্য ১৮৭২ সালে ব্রাহ্ম স্কুলের ভার তুলে দেওয়া হয়েছিল বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর হাতে। তিনি পিতার নামে স্কুলটির নতুন নামকরণ করেন ‘জগন্নাথ স্কুল’। এভাবেই ১৮৭২ সালে ‘ব্রাহ্মস্কুল’ থেকে জন্মলাভ করে জগন্নাথ স্কুল। ১৮৮৪ সালে এ স্কুলকে দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজে রূপান্তর করা হয়। তখন এর নাম বদলে করা হয় ‘ঢাকা জগন্নাথ কলেজ’। পরবর্তী সময়ে ১৮৮৭ সালে শিক্ষা বিভাগের নির্দেশে স্কুল ও কলেজ শাখা আলাদা করা হয়। ১৯০৮ সালে জগন্নাথ কলেজ প্রথম শ্রেণির কলেজের মর্যাদা লাভ করে।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে কলেজটিতে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ হয়ে যায়। জগন্নাথ কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কার্যক্রম বন্ধ করে এটিকে উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে অবনমিত করা হয়। তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের ডিগ্রির শিক্ষক, শিক্ষার্থী, গ্রন্থাগারের বই পুস্তক ও জার্নাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সাজাতে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ গ্রন্থাগারের ৫০ ভাগ বই দান করা হয়।
পুরান ঢাকায় নারী শিক্ষার বাধা দূর করতে ১৯৪২ সালে জগন্নাথ কলেজে সহশিক্ষা চালু হয়। ১৯৪৮ সালে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। দীর্ঘ ২৮ বছর পর ১৯৪৯ সালে আবার এই কলেজে শুরু হয় স্নাতক পর্যায়। ১৯৬৩ সালে পুনরায় সহশিক্ষা চালু হয়। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি সরকারিকরণ করা হলেও পরের বছর এটি আবার বেসরকারি মর্যাদায় ফিরে যায়। ১৯৭৫ সালে এতে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু হয়। ১৯৯১-৯২ শিক্ষাবর্ষ থেকে সরকারি জগন্নাথ কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। সর্বশেষ ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫’ জাতীয় সংসদে পাসের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। শুরু হয় জগন্নাথ কলেজ থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন পথচলা।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৭টি অনুষদে ৩৮টি বিভাগ ও ২টি ইনস্টিটিউটে মোট ৬৮০ জন শিক্ষক রয়েছেন। যার মধ্যে অধ্যাপক রয়েছেন ১৫৬ জন। তন্মধ্যে গ্রেড ১-এর ৩৬ জন, গ্রেড ২-এর ৪৬ জন ও গ্রেড ৩-এর ৭৪ জন। এছাড়া সহযোগী অধ্যাপক ১৭৭ জন, সহকারী অধ্যাপক ২৯০ জন ও প্রভাষক ৬৭ জন। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ১৮ হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। এছাড়া এমফিলে ২৬৫ জন ও পিএইচডিতে ১৫১ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। এ যাবৎকালে জবিতে চারজন বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হন। বর্তমানে তিনজন শিক্ষার্থী রয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি বিভাগে প্রফেশনাল প্রোগ্রাম চালু রয়েছে, আরো বেশ কয়েকটি বিভাগে চালুর প্রস্তুতি রয়েছে। এখানে ৭৩৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে বাংলাবাজারে বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্রীহল ‘বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলে’ আসন বরাদ্দ পেয়েছে ১২০০ জন ছাত্রী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সংকট নিরসনে শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণের ঘোষণা দেন। ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নের জন্য ২০০ একর জমিতে দুই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক। ২০০ একর ভূমির মধ্যে এখনো ১১.৪০ একর ভূমি অধিগ্রহণ বাকি আছে।
মাত্র ১৮ বছরের পথচলায় বিশ্বিবদ্যালয়টির অনেক প্রাপ্তি আছে। বিসিএস, সরকারি ও কর্পোরেট চাকরি, ব্যাংক জবসহ বিভিন্ন চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অসামান্য অবদান রাখছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি, ইন্টারনেট সুবিধা এবং গবেষণাগারেও নজর বাড়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে সমগ্র ক্যাম্পাস ইন্টারনেটের আওতায় আনা হয়েছে। ই-বুক সিস্টেম চালু করা হয়েছে। এখন সব বই ও গবেষণা পত্রিকা পড়ার জন্য শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই অনলাইনে প্রবেশ করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানান, এই ক্যাম্পাস নির্মাণের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আবাসিক সংকট দূর হবে। পাশাপাশি একাডেমিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য সুবিধা পাবেন বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যরা। সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রুটিন দায়িত্বে থাকা উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ বলেন, কম সময়ের মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণের কাজও চলমান রয়েছে। তবে কাজের ধীরগতি থাকলেও শিগগিরই নতুন ক্যাম্পাসের কাজ সমাপ্ত হবে। তখন শিক্ষার্থীদের সব সমস্যার সমাধান হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার চত্বরে সকাল সাড়ে ৯টায় জাতীয় পতাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলন এবং বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের শুভ উদ্বোধন করবেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হক। সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হবে।
এরপর সকাল ১০টায় আনন্দ র্যালি শেষে ভাষা শহীদ রফিক ভবনের নিচতলায় ‘প্রকাশনা উৎসব’ এবং নতুন একাডেমিক ভবনের নিচতলায় ‘বার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী’ এর উদ্বোধন হবে। বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে নাটক (নকশীকাঁথার মাঠ) পরিবেশিত হবে। পরবর্তীতে দুপুরে মুজিব মঞ্চে সংগীত বিভাগের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠনের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকছে। এছাড়াও বিকাল ৪ ঘটিকায় বিশেষ আকর্ষণের মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের (ব্যান্ডদলের) অংশগ্রহণে কনসার্ট।