দীর্ঘ প্রতীক্ষার ফল পেতে যাচ্ছে চাঁদপুরবাসী। অবশেষে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান হয়ে আদালতের প্রতি আস্থা রাখা জেলাবাসী আদালতের দেয়া আদেশকে সাধুবাদ ও বিচারকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
চাঁদপুরের বিতর্কিত, আলোচিত ও ব্যাপক সমালোচিত হওয়া সেই ’বালুখেকো’ সেলিম খানের সম্পত্তির ক্রোক করা রিসিভার করা হলো তিন জেলা প্রশাসক (ডিসি)কে। এ খবরে চাঁদপুর জেলাবাসী ও সচেতন মহল তিন জেলা প্রশাসনের প্রতি তাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে এবং যে কোনো প্রয়োজনে সহায়তায় করবেন বলে তারা মতপ্রকাশ করেছেন।
চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের আলোচিত ও সমালোচিত কারা ভোগকারী চেয়ারম্যান সেলিম খানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও জব্দ করার রায়ের ১ বছর পর ঢাকা, চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি)কে রিসিভার নিয়োগ করার আদেশ দেন আদালত।
অপরদিকে ‘বালুখেকো’ চেয়ারম্যান সেলিম খানকে সরকারি কোষাগারে ২৬৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা জমা দিতে বলেছে চাঁদপুর জেলা প্রশাসন। গত ৪ সেপ্টেম্বর এক চিঠিতে অনতিবিলম্বে এই টাকা জমা দিতে বলা হলেও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কোনো টাকা জমা দেননি তিনি।
আদালতের আদেশে ওই ক্রোক করা সম্পত্তির বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) কামরুল হাসান আদালতের এ সংক্রান্ত চিঠি পান এবং মূল রিসিভার হয়ে তিনি একটি কমিটি গঠন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন বলে তার দপ্তর থেকে দায়িত্বরত কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ও সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. আছাদুজ্জামান গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর সেলিম খানের সম্পত্তি ক্রোক করার আদেশ দেন।
আদেশে বলা হয়, সেলিম খান তার নামে থাকা সম্পদ বিক্রি, হস্তান্তর, স্থানান্তর বা রূপান্তর করতে পারবেন না। একই সঙ্গে আদালতের আদেশ জাতীয় দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রচারের নির্দেশনা দেওয়া হয়। গত ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ওই ক্রোক করা সম্পত্তিতে ৩ জেলা প্রশাসককে রিসিভার নিয়োগ করার বিষয়ে আদেশ জারি করেন।
জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান এ প্রতিনিধিকে বলেন, আদালতের এ সংক্রান্ত আদেশ পেয়েছি। চিঠি পাওয়ার পর স্থানীয় সাবরেজিস্ট্রার অফিসকে জানিয়ে দিয়েছি যেন কোর্ট যে সম্পত্তির ওপর ক্রোকি পরোয়ানা আদেশ দিয়েছেন, সেগুলো বেচাবিক্রি না হয়। এ ছাড়া এসব সম্পত্তি দেখভালের আদেশ অনুযায়ী যা করণীয় তা সঠিকভাবে পালন করা হবে।
এদিকে অন্য এক কর্মকর্তা জানান, এ সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠনে গতকাল থেকে হাজের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। সেলিম খানের নামে স্থাবর সম্পদের মধ্যে আছে লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে ১৯ দশমিক ৮৯ একর জমি, ঢাকার কাকরাইলে পাঁচতলা বাড়ি, কাকরাইলে ৭১৫ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ১০তলা বাড়ি। এসবের মোট মূল্য ২৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে নদী থেকে বালু উত্তোলনের ছয়টি ড্রেজার, ৩টি প্রাইিভেটকার, একটি পিস্তল, একটি শটগান। এর আগে সাড়ে ৩৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং প্রায় ৬৭ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে দুদকের সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধান কর্মকর্তা আতাউর রহমান প্রধান বাদী হয়ে সেলিম খানের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
এদিকে অন্য এক খবরে জানা গেছে, ‘বালুখেকো’ চেয়ারম্যান সেলিম খানকে সরকারি কোষাগারে ২৬৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা জমা দিতে বলেছেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসন। গত ৪ সেপ্টেম্বর এক চিঠিতে অনতিবিলম্বে এই টাকা জমা দিতে বলা হলেও গতকাল পর্যন্ত কোনো টাকা জমা দেননি তিনি। উচ্চ আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনার ডুবোচর থেকে ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বালু তোলার বিপরীতে (রয়্যালটি আদায়) ওই টাকা দিতে বলা হয়। জেলা প্রশাসনের চিঠিতে বলা হয়, সরকারি কোষাগারে টাকা জমা না দিলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সেলিম খান সরকারি কোষাগারে টাকা জমা দিয়েছেন কিনা, জানতে সন্ধ্যায় চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে করা হলে জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান বলেন, ‘এখনো টাকা জমা দেননি তিনি (সেলিম খান)।’
সেলিম খান চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। একই সাথে তিনি মেসার্স সেলিম এন্টারপ্রাইজের মালিক। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি পদ্মা-মেঘনার ডুবোচর থেকে বালু তুলেছেন। তার বিরুদ্ধে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করার অভিযোগ রয়েছে। সেলিম খানের এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে ২০২২ সালে গনমাধ্যমে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়।
সেলিম খানকে চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ২০২২ সালের আগস্ট মাসে জেলা বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় চার বছরে সেলিম খানের প্রতিষ্ঠান মেসার্স সেলিম এন্টারপ্রাইজ কী পরিমাণ বালু তুলেছে, এর বিপরীতে সরকারি কোষাগারে কত টাকা জমা দিতে হবে, তা নির্ধারণ করতে একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। বিভিন্ন জরিপ ও প্রযুক্তির মাধ্যমে উপকমিটি ৪ বছরে সেলিম খান কী পরিমাণ বালু তুলেছেন, তা নির্ধারণ করে।
চিঠিতে বলা হয়, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২১টি মৌজা থেকে সেলিম খান ৬৬৮ কোটি ৩৩ লাখ ২৯ হাজার ৫৮৫ ঘনফুট বালু তুলেছেন। হাইকোর্ট বিভাগের একটি রিট আবেদনের রায়ের ভিত্তিতে প্রতি ঘনফুট বালুর বিপরীতে ৪০ পয়সা রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়। এই হিসাবে ২৬৭ কোটি ৩৩ লাখ ৩১ হাজার ৮৩৪ টাকা জমা দিতে বলেছে জেলা প্রশাসন। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সেলিম খানের মুঠোফোনে কল করা হলে সে কল রিসিভ করেনি।
সেলিম খানকে নিয়ে গত বছর গণমাধ্যমে চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা ও বালু ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বরাত দিয়ে বলা হয়, জনস্বার্থে নৌপথ সচল করার কথা বলে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বালু তুলছেন সেলিম খান। তিনি এ ক্ষেত্রে সরকারি বিধিনিষেধও উপেক্ষা করেন। তিনি উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন দেখিয়ে নদী থেকে বালু তুলেছেন। তিনি ছোট-বড় ২০০ ড্রেজার দিয়ে প্রতিদিন বালু উঠিয়েছিলেন।
২০১৯ সালে দেশব্যাপী ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানকালেও সেলিমের নাম আলোচনায় আসে। যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সেলিম তখন কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।