ঢাকা ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সাঁইয়ের আখড়াবাড়ীর সাধুসঙ্গ শেষ

সাঁইয়ের আখড়াবাড়ীর সাধুসঙ্গ শেষ

বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের ১৩৩তম তিরোধান (মৃত্যুবার্ষিকী) দিবসের তিন দিন দিনের অনুষ্ঠানমালা শেষ হয়েছে। তবে লালন মেলা চলবে কয়েক দিন। সাধুদের ভাবের হাট ভেঙে গেছে বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে। সকালে আখড়া ঘুরে দেখা গেছে, দুর-দূরান্ত থেকে আসা বাউলরা নিজ নিজ আস্তানা ছেড়ে বিছানাপত্র গুছিয়ে রওনা হয়েছে অনেকেই। তবে যাওয়ার আগে একে অপরের সাথে ভাব বিনিময়, ভক্তি-শ্রদ্ধা শেষে বেদনা-কষ্ট নিয়ে সকল বাউল ফকিররা আজ ফিরে যাচ্ছেন যার যার গন্তব্যে।

রাত পোহালে পাখি বলে দেরে খাই দেরে খাই, দয়াল চাঁদ আসিয়া আমায় পার করে নেবে- এমন সৌভাগ্য আমার কবে হবে, এমন গুরুবাদী, দেহতত্ত্ব গানের আসর থাকবে না, থাকবে না এই বাউল ফকিরদের ভিড়।

শরীর ভেঙে প্রাণের সাঁইকে ভক্তি দিয়েছেন তিন দিন তিন রাত। জ্ঞান দিয়েছেন, পেয়েছেন। আসার বেলায় অনেক আনন্দ থাকলেও বিদায়ের বেলায় এটা যেন শান্তির কষ্ট। বিদায় বেলায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে এমন কথা জানালেন বাউল ভক্ত নারী-পুরুষরা। আখড়া বাড়ির পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। গুরুকে বারবার প্রণাম ও নানা রকম ভক্তি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিদায় নেন শিষ্যরা। গুরু ভক্তি আর সিদ্ধ মন নিয়ে বিদায় নেয়ার সময় অনেক বাউল তাদের চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। আবার দেখা হবে সাঁইজির উদাসী ডাকের টানে। গুরু নহির শাহ জানান, সাঁইয়ের জীবদ্দশায় শুধুমাত্র তার ভক্ত আর শিষ্যদের নিয়ে মূলত আড়াই দিনের উৎসব করতেন। সে নিময় মেনেই বাউলরা ‘ভাটাই আসে উজানে’ ফিরে যায় যে যার আপন নিবাসে।

প্রকৃত ভেকধারী বাউলরা সরকারি অনুষ্ঠানের ব্যাপারে খোঁজ-খবরও রাখেন না। তাদের মঞ্চে ডাকলেও তারা আসন ছেড়ে উঠেন না। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে সুর্য্য ওঠার আগেই অহিংস মানবতা প্রতিষ্ঠায় আপন মোকামে গুরুর চরণ ছুয়ে দিক্ষা নিয়ে ভক্তি নিবেদন করে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে অনেক বাউল। লালন আখড়ার আশপাশে ও একাডেমির নিচে যারা আসন গাড়ে, তারা সাঁইকে ভক্তি আর আরাধনায় নিমগ্ন থাকে কখনো স্থান ত্যাগ করে না। বিছানাপত্র হাতে নিয়ে কথা বলেন দিনাজপুরের বাউল গুরু আকবর শাহ। প্রায় একযুগ বাড়িতে ফেরেন না তিনি। সংসার ধর্ম টানে না তাকে। বাড়ির কোনো খবর রাখেন না। সারা বছর পথেই কেটে যায় এ ফকিরের। তবে মাঝেমধ্যে আসেন সাঁইজির ধামে। মনের তৃষ্ণা মেটাতে। পরিপূর্ণ হৃদয় নিয়ে ফিরেন ভবের বাজারে। তবে অনেক বাউল, সাধু আখড়া ছাড়লেও অনেকে গুরুর বাড়িতে থেকে যাবেন আরো ক’দিন।

সমাজ-ইতিহাসের ধারায় বিচার করলে বলা যায়, গ্রামবাংলার মানবতাবাদী মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন লালন ফকির। সামাজিক ভেদনীতি, শ্রেণি-বৈষম্য, বর্ণ, শোষণ, জাত-পাতের কলহ, সামন্ত নিগ্রহও সাম্প্রদায়িক বিরোধের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠস্বর। লালনের নাম আজ দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বের প্রতিটি দেশে উচ্চারিত হয়। একজন গ্রাম্য নিরক্ষর সাধকের এ অর্জন ও প্রতিষ্ঠা স্বভাবতই বিস্ময় জাগায় মনে। মানুষের প্রতি মানুষের শোষণ-বঞ্চনা-অবিচারের চির অবসান কামনা করে সমাজ মনস্ক সাধক লালন শ্রেণিহীন শোষণমুক্ত এক মানবসমাজের স্বপ্ন দেখেছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে তিন দিনব্যাপী ১৩৩তম তিরোধান (মৃত্যুবার্ষিকী) দিবসের অনুষ্ঠানমালার সমাপনী দিনে আলোচনা সভায় কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. এহেতেশাম রেজা’র সভাপতিত্বে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. হেলাল মাহমুদ শরীফ। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এএইচএম আবদুর রকিব। প্রধান আলোচক ছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর ড. সরওয়ার মুর্শেদ রতন, আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট লালন গবেষক ও লেখক অ্যাডভোকেট লালিম হক প্রমুখ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত