কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের পানিরছড়া এলাকার সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত টমটম চালক নুরুল হাসেমের পরিবার পাচ্ছে পাঁচ লাখ টাকা। বর্তমান সরকারের এই প্রশংসনীয় উদ্যোগকে স্বাগতম জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ। ক্ষতিপূরণের টাকা পাচ্ছে বিষয়টি নিশ্চিত করেন কক্সবাজার বিআরটিএ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) উথোয়াইনু চৌধুরী। গতকাল শনিবার সকালে বিআরটিএ কক্সবাজার সার্কেলের (মোটরযান পরিদর্শক) মো. মামুনুর রশীদ বলেন, আজ রোববার জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। এই দিবসটি উপলক্ষ্যে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে মাসব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে কক্সবাজার বিআরটিএ কার্যালয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সড়ক নিরাপত্তাবিষয় সম্পর্কে সচেতন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সচেতনমূলক সেমিনার করা হয়। তিনি আরো বলেন, আজ সকালে বর্ণাঢ্য র্যালি এবং কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের শহীদ এটিএম জাফর আলম সিএসপি সম্মেলন কক্ষে ইমরান সভাপতিত্ব করার কথা রয়েছে। এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পেশার লোকজন উপস্থিত থাকবেন বলে এই কর্মকর্তা জানান। এদিকে গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কক্সবাজার বিআরটিএ কার্যালয়ের পুরো অফিসটি সিসিটিভিতে বেষ্টিত। এই পরিবেশ পূর্বে ছিল না। সিসিটিভির কারণে আগের মতো তেমন জটলাও নেই। প্রয়োজন ছাড়া অযথা মানুষ ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়নি। সেবার মানও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন সেবাপ্রার্থী। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সিসিটিভির দিকে চোখ রাখছেন বিআরটিএ কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) উথোয়াইনু চৌধুরী। কোনো কক্ষে কোনো ধরনের অসঙ্গতি দেখলে ওই কক্ষে ছুটে যাচ্ছেন তিনি। প্রয়োজন ছাড়া কোনো ব্যক্তি একাধিকবার অফিসে ঘুরতে দেখলে প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। বিভিন্নজনকে আবার সতর্কও করা হচ্ছে। অপরদিকে একটি সূত্র বলছে, বিআরটিএ কক্সবাজার কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পাচ্ছে নির্দিষ্ট লগো সম্বলিত জ্যাকেট। এই উদ্যোগটি প্রশংসিত মনে করছেন সচেতন মহল। গতকাল শনিবার সকালে মুঠোফোনে কথা হয় নিহত টমটম চালক নুরুল হাসেমের স্ত্রী আমেনা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, চলতি বছরের বৃহস্পতিবার (১ জুন) কক্সবাজারের মহেশখালীতে পথচারী এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে বাঁচাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে টমটম উল্টে গিয়ে খাদে পড়ে তার স্বামী নুরুল হাসেম (৩৮) নিহত হয়। তিনি হোয়ানক ইউনিয়নের পানিরছড়া গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে। ওইদিন মহেশখালী ইউনিয়নের মাহারাপাড়াস্থ ইউসুফ নুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে প্রধান সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী বিক্ষিপ্তভাবে রাস্তা পার হচ্ছিল। তাকে বাঁচাতে গিয়ে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে টমটমটি খাদে পড়ে উল্টে যায়। এতে চালক নুরুল হাসেম ও সালমা খাতুন গুরুতর আহত হন। তাদের মুমূর্ষু অবস্থায় মহেশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক চালক নুরুল হাসেমকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহতের শ্যালক ওসমান গনি জানান, তার ভগ্নিপতি নুরুল হাসেম বড় মহেশখালী ইউনিয়নের গুলগুলিয়া পাড়ায় শ্বশুরবাড়ি এলাকায় তার অপর ভায়রার সঙ্গে বসবাস করে টমটম চালাতেন।
তিনি আরো জানান, ২০১৮ সালে সরকার নতুন সড়ক পরিবহণ আইন পাস করেন। এ দুর্ঘটনার পর নিহতের স্ত্রী আমেনা বেগম আর্থিক সহায়তা পাওয়ার জন্য ফরম অনুযায়ী দুর্ঘটনা ঘটার ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেন। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিধিমালা অনুসারে, ক্ষতিপূরণের দাবিগুলো ১২ সদস্যের একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে টমটম চালক নুরুল হাসেমের পরিবার পাচ্ছে পাঁচ লাখ টাকা।
আমেনা বেগমের আবেদনে দেয়া তথ্য মতে, নিহত নুরুল হাসেমের এক স্ত্রীসহ সাতজন ছেলে-মেয়ে রয়েছে। সরকারের এই সহযোগিতা নিহত হাসেমের পরিবার ঘুরে দাঁড়াতে ব্যাপক সহায়ক হবে বলে অভিমত প্রকাশ করেন অভিজ্ঞ মহল।
আমেনা বেগম এক প্রতিক্রিয়ায় জানান, সরকারের এই প্রশংসনীয় উদ্যোগকে স্বাগতম জানান। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিআরটিএ কক্সবাজার কার্যালয়ের কর্মকর্তা, স্থানীয় চেয়ারম্যান, সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি তার স্বামীর জন্য দোয়া চেয়েছেন।
এই টাকা দিয়ে কি করবেন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, পরিবারে তিনিসহ সাতজন সদস্য রয়েছে। চার মেয়ে, দুইজন ছেলে। তাদের পড়া-লেখাসহ পারিবারিক খরচে ব্যয় করা হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, জানুয়ারি থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ২৪৩টি আবেদন পেয়েছি। প্রতি আবেদনের সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া আছে। সবকিছু ঠিক হলে ক্ষতিপূরণের চেক হস্তান্তর করা হয়। তিনি আরো বলেন, এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। আগে যারা হতাহত হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে কী হবে, জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, আগেরগুলো আমাদের বিষয় নয়। আর বিধি কার্যকরের আগে তো আমরা যেতে পারছি না।
সূত্র মতে, ২০১৮ সালে সরকার নতুন সড়ক পরিবহণ আইন পাস করে। ওই আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য একটি তহবিল গঠনের কথা বলা হয়। গত জানুয়ারিতে এ সংক্রান্ত বিধিমালা করে সরকার। বিধিমালা অনুসারে, ক্ষতিপূরণের দাবিগুলো ১২ সদস্যের একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে। আর্থিক সহায়তা পাওয়ার জন্য ফরম অনুযায়ী দুর্ঘটনা ঘটার সর্বোচ্চ ৩০ দিনের মধ্যে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হবে। আবেদন দাখিল করার তারিখ থেকে ১০ দিনের মধ্যে বোর্ডের চেয়ারম্যান অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন। এই কমিটি ৩০ দিনের মধ্যে আবেদনকারীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন বোর্ডের কাছে দেবে।
প্রতিবেদন দাখিলের ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ট্রাস্টি বোর্ড আবেদন মঞ্জুরপূর্বক আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বিআরটিএর চেয়ারম্যান এই বোর্ডের চেয়ারম্যান। আর্থিক সহায়তার টাকা আবেদনকারীর ব্যাংক হিসাবে ‘প্রাপকের হিসাবে প্রদেয়’ চেকের মাধ্যমে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে।
এছাড়া বিধিমালায় বলা আছে, আর্থিক সহায়তার জন্য আর্থিক সহায়তা তহবিল থাকবে এবং এই তহবিলে মোটরযান মালিক প্রতিটি মোটরযানের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণে বার্ষিক বা এককালীন চাঁদা দেবেন। এ তহবিল গঠনে মোটরসাইকেলের মালিককে এককালীন এক হাজার টাকা দিতে হবে। বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও প্রাইম মুভারের (বড় লরি) জন্য বার্ষিক দেড় হাজার টাকা দিতে হবে। মিনিবাস, মিনি ট্রাক ও পিকআপের জন্য বার্ষিক ৭৫০ টাকা ধার্য হয়েছে। কার, জিপ ও মাইক্রোবাসের জন্য বার্ষিক ৫০০ টাকা দিতে হবে। আর থ্রি-হুইলার ও অন্যদের বার্ষিক ৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হবে। মোটরসাইকেল ছাড়া অন্যান্য যানের চাঁদা দেওয়ার নির্দিষ্ট মেয়াদ চলে গেলে প্রতি মাস বা মাসের অংশবিশেষের জন্য ৫০ টাকা হারে অতিরিক্ত জরিমানা দিতে হবে।
সূত্র মতে, সরকারের তৈরি করা বিধিমালা অনুসারে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার পাবে পাঁচ লাখ টাকা করে। আর আহত বা অঙ্গহানির জন্য দেওয়া হবে তিন লাখ টাকা।
গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮ এর বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সড়ক পরিবহণ আইনটি হয়েছিল ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। আইন হওয়ার চার বছরের বেশি সময় পর হলো বিধিমালা।