প্রতিদিন চলে অর্ধকোটি টাকার বেচাকেনা

স্বরূপে ফিরছে অপরাধীদের ডেরাঘর খ্যাত চনপাড়া বস্তি

প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বহুল আলোচিত অপরাধী আর অপরাধ জগতের ডেরাঘর খ্যাত চনপাড়া বস্তি অল্প সময়ের ব্যবধানে আবার স্বরূপে ফিরতে শুরু করেছে। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ ও গোলাগুলির কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটলে টনক নড়ে প্রশাসনের। চনপাড়া বস্তির আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের রুটিন অভিযান, মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান, যৌথ বাহিনীর চিরুনি অভিযানসহ প্রশাসনের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রায় মাস তিনেক ভালোই ছিল চনপাড়া বস্তিবাসী। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই আবার আস্তে আস্তে স্বরূপে ফিরতে বসেছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার চনপাড়া বস্তি এলাকা। জায়গাটি মাদককারবারি ও অপরাধীদের অভয়ারণ্য। যে কারণে চনপাড়া বস্তিকে এখন রূপগঞ্জ উপজেলার বিষফোঁড়া বলছেন স্থানীয়রা।

মাদকে সয়লাব রূপগঞ্জ উপজেলা। আর চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র হচ্ছে মাদকের হাট। রাজধানী ঢাকার অতি নিকটে এই বস্তির অবস্থান। এ বস্তিতে রাত-দিন মাদক বেচাকেনা চলে খোলামেলাভাবেই। সন্ধ্যা নামলেই চনপাড়া বস্তিতে মাদকের হাট বসে। মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ঘটেছে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও। স্থানীয় প্রশাসন এখানকার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছে। মাদকের হাট খ্যাত চনপাড়া বস্তি থেকে থানার পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ও কার্ডধারী সাংবাদিকরা বখরা পায় বলে অভিযোগ রয়েছে। রূপগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ ও রাজধানীর ডেমরা, সারুলিয়া, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকার স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী, নানা শ্রেণির পেশাজীবী মানুষ ও তরুণসহ বিভিন্ন বয়সের লোকজন বস্তিতে আসে মাদক সেবন করতে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অপরাধীদের অভয়ারণ্য চনপাড়া বস্তির কর্মকাকাণ্ড এতদিন পর্দার আড়ালে থাকলেও বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন খুন হওয়ার পর তা আলোচনায় আসে। এরই সূত্র ধরে চনপাড়ার ঘটফাদার খ্যাত বজলু আটক হয়, পরে অসুস্থ হয়ে পরলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়। র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে রাশেদুল ইসলাম শাহীন ওরফে সিটি শাহীন মারা যান এবং রাজু আহমেদ ওরফে রাজা র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন। এরপর কয়েকটি গ্রুপ বিভিন্ন সময়ে চনপাড়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা নিয়ন্ত্রণে আনেন। এর পরপর কিছুদিন কিছুটা ভালোই ছিল চনপাড়ার পরিস্থিতি। কিন্তু অপ্ল সময়ের ব্যবধানে আবার স্বরূপে ফিরতে শুরু করেছে অপরাধ ও অপরাধীদের ডেরাঘর চরপাড়া পুনর্বানকেন্দ্র। অনুসন্ধানে জানা যায়, রূপগঞ্জ উপজেলার ৪০০ মাদককারবারির মধ্যে খোদ চনপাড়া বস্তিতে রয়েছে ২০০ জন। মাদকসেবী রয়েছে প্রায় ২০ হাজার। চনপাড়া বস্তিটি বর্তমানে কায়েতপাড়া ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখানে প্রতিদিন অর্ধকোটি টাকার মাদক বেচাকেনা চলে। মাদক বেচাকেনার লাভের একটা অংশ পায় পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, রাজনৈতিক নেতা ও কতিপয় কার্ডধারী সাংবাদিক। এখানে গাঁজাকে বলা হয় রাজা। ফেনসিডিলকে বলা হয় সিরাপ। আর ইয়াবাকে বলা হয় বিচি। স্থানীয়রা জানান, এ বস্তিতে মাদক ব্যবসা ওপেন সিক্রেট। সরকার আসে, সরকার যায়; কিন্তু এই মাদকের হাটের কোনো পরিবর্তন হয় না। বিভিন্ন সূত্রমতে, এ বস্তিতে মাসে ৩ কোটি টাকার মাদক বেচাকেনা হয়। মাদক ব্যবসা করে এখানে কোটিপতি হয়েছেন ২০ জন। এখান থেকে পুলিশ প্রতি মাসে পায় ১০ লাখ টাকা। পুলিশ, এলাকাবাসী ও মাদক সেবনকারীদের তথ্যমতে, মাদকসেবীদের কেউ কেউ শীতলক্ষ্যার বুকে নৌকায় চড়েও মাদকসেবন করে। এলাকাবাসীরা জানান, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার সীমান্তবর্তী শীতলক্ষ্যা এবং বালু নদের মোহনায় চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র অবস্থিত। চনপাড়ায় প্রায় লাখো লোকের বসবাস। এ কেন্দ্রে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ রয়েছে অনেক। একদিকে পুলিশ প্রবেশ করলে মাদকসেবীরা অন্যপথ দিয়ে বের হয়ে যায়। আর এ কারণেই এখানে মাদক ব্যবসা জমজমাট। রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সায়েদ বলেন, ‘চনপাড়া বস্তিতে মাদক আছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে অনেকটা কমে এসেছে। চনপাড়ায় পুলিশের একটি টিম প্রতিদিন অভিযান পরিচালনা করে। এলাকাটা ঘিঞ্জি তো, পুলিশ ঢোকার আগেই মাদককারবারিরা পালিয়ে যায়।’ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফয়সাল হক বলেন, ‘চনপাড়া বস্তি হচ্ছে মাদকের অভয়ারণ্য। এখানে হাত বাড়ালেই মাদক মেলে। বড় ধরনের অভিযান ছাড়া মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করা খুবই কঠিন।