নির্বিচারে বনভূমি উজাড় হওয়ার কারণে কক্সবাজারের দক্ষিণ ও উত্তর বনবিভাগের বনাঞ্চলে চরম খাদ্য ও আবাসস্থল সংকট দেখা দিয়েছে। যার ফলে বিপন্ন বন্যহাতি লোকালয়ে এসে হানা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। খাদ্য ও আবাসস্থল সংকটের কারণে লোকালয়ে এসে বন্যহাতির অস্বাভাবিক মৃত্যুও হচ্ছে। বেশির ভাগই হাতি বৈদ্যুতিক তারের সঙ্গে জড়িয়ে মারা হচ্ছে বলে দাবি করছেন পরিবেশবাদী সংগঠন ও স্থানীয় সচেতন মহল। তাদের দাবি, মানতে নারাজ বনবিভাগ। গতকাল মঙ্গলবার কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের পানেরছড়া রেঞ্জের পানেরছড়া বনবিটের গহিন পাহাড়ে একটি বাচ্চা হাতির মরদেহ পাওয়া গেছে। এতে গত চারবছরে কক্সবাজারে পৃথকভাবে ১৭টি বন্যহাতির মৃত্যু হয়েছে। তবে বিষয়টি মানতে নারাজ কক্সবাজার দক্ষিণ ও উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, তাদের কর্মকালীন ২ বছরে কক্সবাজারে ৮টি বন্যহাতি মারা গেছে। একের পর এক বিপন্ন বন্যহাতির মৃত্যু নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন পরিবেশবাদী সংগঠন।
স্থানীয়রা বলছেন, প্রায় সময় জঙ্গল ছেড়ে পাড়া-মহল্লায় ঢুকছে বন্যহাতি। বন্যহাতির আতঙ্কে অনেক মানুষজন। হাতির করিডোর বা আবাসস্থলগুলোতে স্থাপনা নির্মাণ করছে মানুষ। ফলে হাতির বিচরণের জায়গা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে মানুষের ক্ষতি করতে শুরু করছে হাতি। যেসব এলাকায় হাতি বিচরণ করত, সেসব স্থানে গড়ে উঠেছে স্থাপনা ও পিকনিক স্পট। অন্যদিকে হাতির খাবারও সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে এখন হাতি মরিয়া হয়ে উঠেছে। সবুজ বনভূমি বর্তমানে ন্যাড়া পাহাড় হয়ে গেছে।
সূত্র মতে, বন্যহাতির মৃত্যুর পর একজন ভেটেরিনারি সার্জন ময়নাতদন্তের জন্য ঘটনাস্থলে যান। তবে আজ পর্যন্ত কয়টি হাতির ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এসেছে তাও জানেন না বনবিভাগ। এই বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার বিকালে কক্সবাজার দক্ষিণ বিভাগের (বন্যপ্রাণী ও জীবৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা) ইশরাত ফাতেমার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি হাতির মৃত্যুর পরিসংখ্যান ও ময়নাতদন্তের তথ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেন, যা দরকার তা দিব’।
কক্সবাজার ও টেকনাফের দায়িত্বরত সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. মনিরুল ইসলাম পানেরছড়া এলাকায় বাচ্চা হাতির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, গতকাল সকাল ১০টার দিকে রামু উপজেলার পানেরছড়ার হোয়ারিয়ঘোনার পাহাড়ে এ বাচ্চা হাতির মরদেহটি দেখতে পেয়ে বনবিভাগকে খবর দেয় স্থানীয়রা। সেই সূত্রে ঘটনাস্থলে যায় বনবিভাগ। তিনি দাবি করেন, মৃত বন্যহাতিটির পেট ফুলে গেছে। হাতির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব নমুনা ঢাকা পাঠানো হচ্ছে। নমুনার প্রতিবেদন হাতে আসলে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, ৭-৮ বছরের বাচ্চা হাতিটি নারী। প্রাথমিকভাবে খাদ্যে বিষক্রিয়াজনিত কারণে এটি মারা যেতে পারে। বৈদ্যুতিক তারে এটিকে হত্যা করা হয়েছে এমন প্রশ্ন করা হলে তা মানতে নারাজ এই কর্মকর্তা। পরিবেশবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপল এর প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ জানিয়েছেন, হাতিটির বিষয় নিয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে তিনি আলাপ করেছেন। স্থানীয়রা বলছেন, মঙ্গলবার রাতে বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে হত্যাটি হত্যা করা হয়েছে। এটি একটি এশিয়ান হাতি।
তিনি বলেন, হাতি হত্যা অপরাধ। বনবিভাগ প্রায় সময় হাতির মৃত্যুর পর নানা অজুহাতে প্রকৃত সত্য প্রকাশ করেন না। অনেক ক্ষেত্রে হত্যায় জড়িতের সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্থ নিয়ে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন। হাতি হত্যায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে এটা বন্ধ করা যাবে না। এই প্রসঙ্গে গতকাল বিকালে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সারওয়ার আলম বন্যহাতির মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেন। তবে তার কর্মকালীন ২ বছরে ৪টি হাতির মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেন। একইভাবে দাবি করলেন উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) মো. আনোয়ার হোসেন সরকার। গতকাল কক্সবাজারের প্রাণিসম্পদ অফিসার ও ভেটেরিনারি অফিসার ডা. মো. সাহাবউদ্দিনের মুঠোফোনে কয়েকদফা যোগাযোগ করলে তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। পরে রামু উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. অসীম বরন সেন-এর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনিও ফোন রিসিভ করেনি। তার হোয়াটসঅ্যাপে প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে মেসেজ পাঠানো হয়, তারও কোনো উত্তর দেননি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত।
গতকাল সন্ধ্যায় পানেরছড়া বিট কর্মকর্তা মো. জলিলুর রহমান বলেন, মৃত বাচ্চাটি সন্ধ্যায় পুঁতে ফেলা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ৪ বছরে কক্সবাজার ও আশপাশের বনাঞ্চলে অন্তত ১৭টি হাতির অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। বেশির ভাগ হাতির মৃত্যু হয়েছিল গুলি ও বৈদ্যুতিক ফাঁদে আটকা পড়ে। স্থানীয় লোকজন জানান, ২০২১ সালের ৩০ আগস্ট রামু উপজেলার ধোয়াপালং গ্রামে ধানখেতে বিদ্যুতের শক দিয়ে হত্যা করা হয় একটি বন্যহাতি। ঘটনা ধামাচাপা দিতে তখন হাতিটিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে মাটিকে পুঁতে ফেলা হয়। স্থানীয় কাঠুরেরা হাতির শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন মাথা ও পা মাটিচাপা দিতে দেখে বনকর্মী ও পুলিশকে খবর দিলে ঘটনা ফাঁস হয়।