ডিজিএফআই-এর কর্মকর্তাসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একাধিক আলোচিত হত্যাকাণ্ডে সঙ্গে সরাসরি জড়িত, সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার শীর্ষ কমান্ডার ও টর্চার সেলের প্রধান ওসমানসহ দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৪ এক্সটেনশন এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। এ সময় ১টি নাইন এমএম বিদেশি পিস্তল, ৪ রাউন্ড গুলি, ৪টি একনলা ওয়ান শুটার গান, ২টি এলজি, ৫ রাউন্ড, ১২ বোর কার্তুজ এবং টর্চার সেলের বিপুল পরিমাণ সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়।
গতকাল শুক্রবার সকাল ১১টায় র্যাব-১৫ ব্যাটালিয়ন কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব সদর দপ্তরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাবের কাছে খবর আসে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন গহিন পার্বত্য এলাকাগুলোয় ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা)’সহ বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ খুন, অপহরণ, ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। যার কারণে রোহিঙ্গা শিবির ও স্থানীয় এলাকাবাসী সবসময় ভীত সন্ত্রস্ত থাকে। এর প্রেক্ষিতে র্যাব-১৫ এ সব সন্ত্রাসী গ্রুপের শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ অন্যান্য সদস্যদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।
তারই ধারাবাহিকতায় র্যাবের চৌকস আভিযানিক দল রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এর তথ্যের ভিত্তিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৪ এক্সটেনশন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে আরসার শীর্ষ কমান্ডার ও ওলামা বডি ও টর্চার সেলের প্রধান মৃত নুরুজ্জামানের ছেলে মো. ওসমান ওরফে সালমান মুরব্বী (৫০) কে গ্রেপ্তার করে। পরবর্তীতে তার তথ্যের ভিত্তিতে মধুরছড়া জামে মসজিদ সংলগ্ন পাহাড়ে আরসার তৈরি একটি গোপন টর্চার সেলের সন্ধান পায় এবং সেখান থেকে টর্চার সেলের সদস্য সৈয়দ হোসেনের ছেলে মো. ইউনুস (২৪) কে গ্রেপ্তার করা হয়।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, গ্রেপ্তারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সালমান মুরব্বী ২০১৭ সালে সপরিবারে অবৈধপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে থাইংখালীর রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১৩ এর ব্লক-ডি/৪ এ বসবাস শুরু করে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে সে আরসার ওলামা কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য ও কমান্ডার মৌলভী মোস্তাক আহম্মদ এবং মৌলভী আবু রায়হানের সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা) এ যোগদান করে। সংগঠনে যোগদানের পর শীর্ষ নেতাদের কাছে অস্ত্র চালনাসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। পর্যায়ক্রমে সে ১৩ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্লক জিম্মাদার, হেড জিম্মাদার এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আরসার ওলামা বডির প্রধান হিসেবে নেতৃত্ব লাভ করে। তার নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গা শিবিরে আরসার দাওয়াত গ্রুপের অন্যতম সদস্য মৌলভী লাল মোহাম্মদের নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ জনের একটি গ্রুপ তৈরি করে; যারা ক্যাম্পে বসবাসকারী তরুণ ও যুবকসহ সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রলোভন দেখিয়ে অথবা জোরপূর্বক আরসায় যোগদান করত। তার এ কার্যক্রমের মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা আরসায় যোগদান করেছে বলে জানা যায়।
এছাড়াও আরসা প্রধান আতাউল্লাহ ও আরসার সেকেন্ড ইন কমান্ড ওস্তাদ খালেদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করত এবং আরসার শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপে যুক্ত ছিল। ওই গ্রুপগুলোর মাধ্যমে শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ আরসার কার্যক্রম সংক্রান্ত বিভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করত। রোহিঙ্গা শিবির ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় কোনো ধরনের হামলা বা নাশকতার জন্য সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার সদস্যরা সালমান মুরব্বীর পরামর্শে হামলা ও অরাজকতা সৃষ্টি, হত্যাকাণ্ড, অপহরণসহ নানাবিধ সন্ত্রাসী কার্যক্রম সংঘঠিত করত। গ্রেপ্তারকৃত সালমান মুরব্বীর নেতৃত্বে ওলামা বডির অন্যান্য সদস্যরা আরসার নতুন সদস্য যোগদানে উদ্বুদ্ধকরণের পাশাপাশি আরসা হতে বের হয়ে বিভিন্ন নেতৃত্বদানকারীদের হত্যার পরিকল্পনা, হামলা, ভয়ভীতি প্রদর্শন করত। তাছাড়াও আরসা ওলামা বডির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এ সকল অপরাধের ফলে ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গারা সবসময় ভীতসন্ত্রস্ত থাকত। কেউ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তারা তাকে অপহরণ ও হত্যাসহ ক্ষেত্র বিশেষ লাশ গুম করত বলে জানা যায়।
তাদের আরো জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আরসা প্রধান আতাউল্লাহর নির্দেশনায় আরসার আধিপত্য এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে আরসা ২০১৯ সালের শেষের দিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে ও ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড় ও গহিন জঙ্গলে টর্চার সেল-কাচারী স্থাপন করে। আরসার কমান্ডার আবু আনাছ সর্বপ্রথম টর্চার সেলের প্রধানের দায়িত্ব পালন করে। পরবর্তীতে মৌলভী আকিজ ওলামা বডির প্রধানের দায়িত্ব নেয় এবং চলতি বছরের শুরুতে সে মিয়ানমারে চলে গেলে গ্রেপ্তারকৃত সালমান মুরব্বী ওলামা বডির প্রধান ও উক্ত টর্চার সেলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই কাচারি বা টর্চার সেলের দায়িত্বে থাকা প্রধান ও অন্যান্য সদস্যরা সাধারণ রোহিঙ্গাদের বিচারের নামে শাস্তিসহ নানাবিধ নির্যাতন করে থাকে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে আগ্রহী ও আরসার ভিন্ন মতাদর্শীদে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন ধরনের কঠোর শাস্তি, অত্যাচার ও নির্যাতন চালানো হতো এই টর্চার সেলে। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্প’কে কয়েকটি জোনে বিভক্ত করে গ্রেপ্তারকৃত সালমান মুরব্বীর নেতৃত্বে মাস্টার কামাল, মাস্টার ইউনুছ, জাফর আলম, মৌলভী যুবায়ের, মাস্টার আবুল হাশিম, মাস্টার সলিম প্রমুখ আরসার কমান্ডাররা এই ভয়ঙ্কর কাচারি বা টর্চার সেলের বিভিন্নভাবে সাধারণ রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করে বলে জানা যায়। এছাড়াও ক্যাম্পে বিভিন্ন লোকজন ও স্থানীয় বাঙালিদের অপহরণ করে টর্চার সেলে আটকে রেখে নির্যাতনের মাধ্যমে বড় অংকের মুক্তিপণ আদায় করত, কখনও কখনও চাহিদা মতে মুক্তিপণের টাকা আদায় করতে অপহৃত ব্যক্তির উপর পৈশাচিক নির্যাতন চালাত এই সন্ত্রাসী সংগঠন আরসা। গ্রেপ্তারকৃত সালমান মুরব্বী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১৯-এর হেড মাঝি আনোয়ার ও সাবমাঝি ইউনূস হত্যাকাণ্ড, জসিম হত্যাকাণ্ডসহ ক্যাম্প-১৩ এর সব হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং আলোচিত ছয়জন হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড এবং বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল দলের উপর সশস্ত্র হামলার সঙ্গে সে জড়িত রয়েছে বলে জানা যায়। এছাড়াও সালমান মুরব্বি ও ইউনুস ২০২২ সালের নভেম্বরে গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাবের মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময় সন্ত্রাসীদের হামলায় গোয়েন্দা সংস্থার একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত হন। উক্ত সন্ত্রাসী হামলায় একজন র্যাব সদস্য গুরুতর আহত হন। উক্ত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সে সরাসরি জড়িত ছিল এবং উক্ত মামলার পলাতক এজাহার নামীয় আসামি। তার বিরুদ্ধে কক্সবাজারের বিভিন্ন থানায় হত্যা, অপহরণ ও অস্ত্রসহ বিভিন্ন অপরাধে ৬টির অধিক মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছেন র্যাবের এ কর্মকর্তা।