ঘূর্ণিঝড় হামুনের তাণ্ডবে পুরো কক্সবাজার লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও কৃষিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে করে চাষের জমির সব ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছে জেলার প্রায় ৫০ হাজার কৃষক। এছাড়া কক্সবাজার শহরসহ জেলার মহেশখালী উপজেলার অধিকাংশ এলাকা এখনো অন্ধকারে। ফলে শহরজুড়ে পানির জন্য হাহাকার চলছে। একই সঙ্গে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক স্বাভাবিক না হওয়ায় চরম ভোগান্তিতে রয়েছে মানুষ। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মহেশখালীর অধিকাংশ এলাকা অন্ধকারে রয়েছে। তাদের তথ্য মতে, বিদ্যুৎ পেতে দুই সপ্তাহ সময় লাখবে বলে কতৃপক্ষ জানিয়েছেন। বিষয়টি জানার জন্য গতকাল সন্ধ্যায় মহেশখালী পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. আল আমিনের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে কক্সবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫ লাখ মানুষ। ভেঙে গেছে ৩৮ হাজারের বেশি বসতঘর। গাছের উপর ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব চলেছে সবচেয়ে বেশি। হাজার হাজার গাছ ভেঙে চলাচল যেমন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে, তেমনি জটিল করে দিয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রক্রিয়াও। এই তাণ্ডবে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতাধীন ৩৩ কে.ভি লাইনের ১৭৪টি, ১১ কে.ভি লাইনের ১৮০টি বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে গেছে। ২৩টি ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়েছে। ৪৯৬টি স্পটে ক্যাবল ছিঁড়ে গেছে। ১ হাজার ৮৩৮টি মিটার নষ্ট হয়েছে। ৮০০টি স্পটে গাছ পড়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
তিন দিন পরও কক্সবাজার শহরের কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা সম্ভব হলেও পৌর এলাকার বেশিভাগ এখনও বিদ্যুৎহীন। বিদ্যুৎ বন্ধ রয়েছে মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া উপজেলা। একই সঙ্গে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক আসা-যাওয়ার মধ্যে রয়েছে।
কক্সবাজার বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল কাদের গণি বলেন, গত বুধবার সন্ধ্যা থেকে গতকাল পর্যন্ত কক্সবাজার শহরের বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু এতেও নানা প্রতিবন্ধকতা ও জটিলতা দেখা দিচ্ছে। সরবরাহ শুরু হওয়া পরও কিছু কিছু এলাকায় গাছ ভেঙে থাকা, ক্যাবল ছিঁড়ে থাকার কারণে সরবরাহ বন্ধ করতে হচ্ছে। পুরোদমে বিদ্যুৎ কর্মীরা কাজ করছেন। আরও একদিন সময় লাগতে পারে।
বিদ্যুৎ না থাকার কারণে কক্সবাজার শহরজুড়ে এখন পানির তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। কক্সবাজার শহরের লালদীঘিরপাড়, পেশকারপাড়া, নুরপাড়া, বদরমোকাম, টেকপাড়া, পাহাড়তলী, মোহাজের পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় পানির জন্য চলছে।
কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী এলাকার বাসিন্দা এমরান ফারুক অনিক জানিয়েছেন, কক্সবাজার পৌরসভার দক্ষিণ পাহাড়তলির ইসলামপুর এলাকায় গত ৪৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন রয়েছে। কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ পিলার বাঁকা যাওয়ার অজুহাতে বড় একটি অংশকে বিদ্যুৎহীন করে রেখেছে। অথচ এখানে বৈদ্যুতিক ক্যাবল ছিঁড়েনি এবং পিলারও মাটিতে না। খাবার পানি সংকটে রয়েছি, এরচেয়ে বড় কথা ব্যবহারের পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। দ্রুত বিদ্যুতের ব্যবস্থা গ্রহণ করে হাজার হাজার মানুষকে পানি সংকট দূরীকরণের জন্য অনুরোধ জানান তিনি।
লালদীঘির পাড়ের ফরিদুল আলম নামের এক বাড়ি মালিক জানান, দীর্ঘদিন ধরে তাদের নিজস্ব পানির লাইনটি লবণাক্ত হওয়ায় পৌরসভার সরবরাহকৃত পানির উপর নির্ভর করতে হয়। গত বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে এই এলাকা বিদ্যুৎ চালু হয়েছে। কিন্তু পৌরসভার পানি সরবরাহ শুরু না করায় পানি নিয়ে ভোগান্তিতে রয়েছে। খাবার পানি বাজারে বোতলজাত পানি কেনা হচ্ছে। কিন্তু ব্যবহারের পানি নেই বুধবার রাত থেকে।
টেকপাড়া এলাকার আবদুল গফুর জানান, বুধবার রাত থেকে পানি সংকটে রয়েছে। এই এলাকায় বৃহস্পতিবার দুপুরে একটু বিদ্যুৎ এলেও পরে বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে মোটর না থাকায় পানি উঠানো যাচ্ছে না।
কক্সবাজার শহরের সমুদ্র নিকটবর্তী সমিতিপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড় হামুনের তাণ্ডবে বসতির উপর উপড়ে পড়া শত শত ঝাউগাছ এখনও রয়েছে। যা সরানো কাজ করছে মানুষ।
ওই এলাকার আব্দুল হামিদ, বিলকিস বেগম ও হাসনা হেনাসহ অনেকেই জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে বিধ্বস্ত তাদের বসতি। তাদের দু’দিনেও কেউ খোঁজখবর বা কোনো ধরনের সহায়তা দেয়নি।
কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার (প্রকৌশলী) গোলাম আহম্মদণ্ডএর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিদ্যুৎ এ ব্যাপক ক্ষতির বিষয়টি দাবি করেন। তবে নিদিষ্ট ক্ষতির তালিকা নিরুপণ করতে সময় লাগবে বলে জানান।
৬ হাজার ২৭৫ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত : কক্সবাজারের ৯টি উপজেলার প্রতিটি গ্রামেই ফসলি জমি ও শীতকালীন সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এতে করে দুশ্চিন্তায় দিশাহারা কৃষকরা। গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. কবির হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তার দেয়া তথ্য মতে, হামুনের আঘাতে কক্সবাজার জেলায় ৬ হাজার ২৭৫ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হয়েছে, যার মধ্যে আমন, ফল ও পানের বরজসহ রবি শস্য শীতকালীন সবজি রয়েছে।
এরমধ্যে, মহেশখালীতে ৪ হাজার ৭৩০ হেক্টর, চকরিয়ায় ৪০৫ হেক্টর, কুতুবদিয়া ২২০ হেক্টর, পেকুয়ায় ১০০ হেক্টর, কক্সবাজার সদরে ৫০০ হেক্টর, রামু ৭৬ হেক্টর, উখিয়ায় ১৪৪ হেক্টর এবং টেকনাফে ১০০ হেক্টর চাষের জমিতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে করে চাষের জমির সব ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছে দিশাহারা প্রায় ৫০ হাজার কৃষক।
গত বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় মহেশখালীর হোয়ানক খোরশা পাড়ার পানচাষি আলী হোসেন বলেন, আমরা চার ভাই মিলে ১২০ বারের চারটি পানবরজ চাষ করেছি। ঘূর্ণিঝড়ে চারটি বরজই পুরোপুরি ধসে গেছে। আমার যা সম্বল সব ওই পানবরজগুলো খরচ হয়ে গেছে। এখন বরজগুলো মেরামত করার মতো আমার কোনো টাকা নেই।
প্রসঙ্গত : জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে জেলার ৭০টি ইউনিয়ন, কক্সবাজার ও মহেশখালী পৌরসভার ৩৭ হাজার ৮৫৪ বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫ হাজার ১০৫টি এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩২ হাজার ৭৪৯টি বাড়ি-ঘর। এতে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫৪৯ জন মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।