গাজায় ইসরাইলি হামলার ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানকার পরিস্থিতি দিন দিন সংকটময় হয়ে উঠছে। অবরুগ্ধ গাজাবাসীর বিরুদ্ধে নির্মূল অভিযান শুরু করেছে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী। কোনো আপসরফা কিংবা য্দ্ধু বিরতির পক্ষে নয় ইসরাইল। ফলে অনিশ্চিতার মুখে পড়েছে গাজাবাসী। গাজার নিরীহ নারী ও শিশুদের ব্যাপারে ক্রমশ উদ্বেগ বাড়ছে।
গাজায় আর কোনো নিরাপদ জায়গা নেই বলে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে জাতিসংঘ। ইসরাইলের হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা। গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করতে জর্ডান সফরে গেছেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে ইসরাইল। গাজার অ্যাম্বুলেন্স বহরে ইসরাইলের নতুন করে হামলায় নিহত ১৫ জন নিহত হয়েছেন।
ফিলিস্তিন-ইসরাইল সহিংসতা দিন দিন ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। প্রতিদিনই অবরুদ্ধ গাজায় হামলা চালাচ্ছে ইসরাইলি সেনারা। এই পরিস্থিতিতে গাজায় আর কোনো নিরাপদ জায়গা নেই বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে জাতিসংঘ। গাজার বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের আর তেমন কিছুই করার নেই বলেও জানিয়েছেন জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার পরিচালক থমাস হোয়াইট।
সহিংসতার শুরু থেকে জাতিসংঘের পরিচালিত স্কুলগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন লাখো ফিলিস্তিনি। তাদের উদ্দেশে থমাস হোয়াইট বলেছেন- ‘আমরা এখন আর জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গাজার আশ্রিতদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছি না। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে থেকে ৩৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তবে এর জন্য কোনো পক্ষ বা কারা দায়ী তা স্পষ্ট না।’
গত অক্টোবরের ৭ তারিখ সহিংসতা শুরু হওয়ার পর প্রায় ৬ লাখের মতো মানুষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত স্কুলগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। গাজায় ইসরাইলি হামলায় এরই মধ্যে ৯ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন ২২ হাজারের বেশি মানুষ।
এদিকে যুদ্ধবিরতির উদ্দেশে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্র ও আরব দেশের নেতারা। তবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের বৈঠকের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
গাজায় ‘অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব’ নিয়ে ইসরাইলের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর এবার জর্ডানে গেলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। রাজধানী আম্মানে মধ্যপ্রাচ্যের পাঁচ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে তার বৈঠক করার কথা রয়েছে। গাজায় ইসরাইলের অব্যাহত হামলার মধ্যেই গতকাল এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। গত শুক্রবার গভীর রাতে রাজধানী আম্মানে পৌঁছেছেন ব্লিঙ্কেন। পৌঁছানোর পর গতকাল জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন তিনি। সেখানে মিশর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করবেন ব্লিঙ্কেন। এ সময় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের একজন প্রতিনিধিও উপস্থিত থাকবেন। উল্লেখ্য, ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হামাস বিরোধী। সম্প্রতি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে ফোনালাপকালে অবিলম্বে গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন বাদশাহ আবদুল্লাহ।
ইসরাইল এবং পশ্চিম তীরের সীমান্তবর্তী দেশ জর্ডানের রাজধানী আম্মানে গাজাবাসীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে গত শুক্রবার প্রায় ৫ হাজার জর্ডানিয়ান বিক্ষোভ করেন। এ সময় গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য ইরাইলকে চাপ দেওয়ার আহ্বানও জানান তারা। এর আগে, বুধবার, গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে ইসরাইল থেকে তার রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে জর্ডান। অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি’র প্রস্তাবে অসম্মতি জানিয়েছে ইসরাইল। হামাসের জিম্মায় থাকা ২৪০ জনের বেশি জিম্মিদের মুক্তি না দিলে গাজায় কোনো ধরনের অস্থায়ী বিরতির দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এই খবর জানিয়েছে।
গাজায় ‘অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি’ নিয়ে আলোচনা করতে শুক্রবার তেল আবিব সফরে যান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। সেখানে পৌঁছে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। বৈঠক শেষে এসব কথা বলেন নেতানিয়াহু।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যে প্রস্তাবে ইসরাইলের সব জিম্মিকে ছাড়ানোর শর্ত নেই সেই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ইসরাইল। তাদের মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত গাজায় ‘পুরোদমে’ হামলা অব্যাহত থাকবে। নেতানিয়াহু সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, গাজায় কোনো জ্বালানি প্রবেশ করতে দেবে না ইসরাইল। ব্লিঙ্কেনের সফরের দিনেও গাজার একাধিক স্থানে ইসরাইলের হামলায় হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। সর্বশেষ, গাজায় অ্যাম্বুলেন্স বহরে ইসরাইলি হামলার খবর পাওয়া গেছে। এতে ১৫ জন নিহত ও আরো কয়েকজন আহত হয়েছে। গত ৭ অক্টোবর হামলা চালিয়ে প্রায় ২৫০ ইসরাইলিকে বন্দি করে নিয়ে আসে সশস্ত্রগোষ্ঠী হামাস। এর প্রতিক্রিয়ায় হামাসকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে গাজায় নির্বিচারে বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে দখলদার ইসরাইল বাহিনী। গত ২৮ অক্টোবর থেকে স্থল হামলাও শুরু করেছে তারা।
গত শুক্রবার হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজায় ইসরাইলের পাল্টা হামলায় এখন পর্যন্ত ৯ হাজার ২২৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩ হাজার ৮২৬ জন শিশু। এদিকে, এ সংঘাতে এখন পর্যন্ত ইসরাইলে ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে।
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর পরিকল্পিত সহিংসতায় হতাহত শিশু-নারী ও বেসামরিক লোকজনকে দেখেও যাদের প্রাণ কেঁদে না ওঠে, তাদের হৃদয় পাথরের তৈরি বলে মন্তব্য করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
অবশ্য তিনি এ কথাও বলেছেন যে, গাজায় ধ্বংসযজ্ঞকে কোনো কোনো পক্ষ সহিংসতা উসকে দিতে ব্যবহার করতে পারে। সুতরাং, এ ব্যাপারেও সবার সতর্ক থাকা প্রয়োজন। শুক্রবার মস্কোতে এক উচ্চপর্যায়ের সরকারি বৈঠকে পুতিন বলেন, ‘একটি স্ফুলিঙ্গ কিংবা গোলা নিক্ষেপ করা সহজ, খুবই সহজ; কিন্তু তারপর যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আপনি যদি স্বাভাবিক মানুষ হন, তাহলে যখন হামলায় রক্তাক্ত শিশুদের যন্ত্রণা আপনি নিজের চোখে দেখবেন, এ সময় আপনার হাতের মুঠো দৃঢ় হবে এবং চোখ অশ্রুতে ভরে উঠবে। সাধারণ লোকজনের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটতে থাকে।’ ‘কিন্তু এসব ভয়াবহ দৃশ্য দেখার পরও যারা স্বাভাবিক রয়েছে, কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না- তারা দেখতে মানুষের মতো হলেও আসলে তাদের হৃদয় নেই; কিংবা যদি থেকেও থাকে- তাহলেও সেই হৃদয় রক্ত-মাংস দিয়ে নয়, পাথরে তৈরি।’ সূত্র বিবিসি ও আলজাজিরা