চলছে হেমন্তকাল। শীত মৌসুম আসতে এখনো বেশ কিছুদিন বাকি। এরই মধ্যে নাটোরের গ্রামাঞ্চলে শুরু হয়েছে শীতের আমেজ। রাতে ঠান্ডা-হিমেল বায়ু আর সকালের শিশিরভেজা ঘাস-পাতাই জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে গাছিদের খেজুরের রস সংগ্রহের প্রস্তুতি। পাশাপাশি চলছে খেজুরের রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরি গাছিদের নিয়ে কর্মশালা। আর গৌরব ও ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ খেজুরগাছ পরিচর্যা-পরিষ্কারসহ রস সংগ্রহের উপযোগী করতে প্রতিদিন ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরাও। আর মাত্র কয়েক দিন পরই পাওয়া যাবে মিষ্টি-মধু সেই কাঙ্ক্ষিত খেজুরের রস, যার ঘ্রাণে মৌ মৌ হয়ে উঠবে পুরো এলাকার বাতাস। গ্রামীণ জীবনের প্রাত্যহিক উৎসব শুরু হবে খেজুরের মিষ্টি রসকে ঘিরে। পুরো শীত মৌসুমজুড়ে চলবে সু-স্বাদে ভরা বিভিন্ন ধরনের পিঠা উৎসব। এছাড়া পায়েস-পুলিসহ নানা রকম খাওয়ার আয়োজন তো রয়েছেই। শীতের মৌসুমে খেজুরের রস ও গুড়সহ পিঠা খেতে শহর থেকে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে আসেন অনেকেই। শীতের সকালের রৌদ্রে খেজুরের রস ও মুড়ি খাওয়ার আসর বসে বাড়ির আঙিনায়। শীত মৌসুমে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে উৎসব মুখর পরিবেশে খেজুরের গুড় দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরির আয়োজন করা হয়। সেই প্রতীক্ষায় আছেন গ্রামের মানুষ।
নাটোর জেলার সব উপজেলাতেই খেজুরগাছ থাকলেও লালপুর উপজেলায় তুলনামূলক খেজুরের গাছের সংখ্যা ও গুড় উৎপাদন হয় সবচেয়ে বেশি। এর পরই রয়েছে বড়াইগ্রাম উপজেলা। তবে বড়াইগ্রাম উপজেলায় খেজুরের গাছ ও গুড় উৎপাদনের পরিসংখ্যান নেই। নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় মোট খেজুরগাছ রয়েছে ৬ লাখ ২৭ হাজার ৭৯০টি। এর মধ্যে রস সংগ্রহের উপযোগী গাছ রয়েছে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৬২২টি। শীত মৌসুমে ৭৫ দিনে প্রতিটি গাছ থেকে ১৭৪ কেজি রস পাওয়া যায়। আর প্রতিটি গাছের রসে গুড় উৎপাদন হয় ১৭ দশমিক ৪০ কেজি। জেলায় প্রতি মৌসুমে গড়ে প্রায় ৯ হাজার ৬২৩ মেট্রিক টন (৯৬ লাখ ২৩ হাজার ৮৬২ কেজি) খেজুর গুড় উৎপাদন হয়, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১০৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি বছর নাটোর জেলায় ১০৫ কোটি টাকার খেজুর গুড় উৎপাদন ও বাজারজাত হয়।
গত মৌসুমে প্রায় শত কোটি টাকার খেজুর গুড় উৎপাদন হয়েছে। হলুদঘর গ্রামের খলিলুর রহমান জানান, প্রতি বছর প্রায় ১০০টির মতো গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন তিনি। গত বছরের তুলনায় এবার আরো ২০টি গাছ বেশি প্রস্তুত করছেন। তিনি বলেন, শীতের সময় খেজুরের গুড় তৈরি ও বিক্রি করে তার সংসার ভালোই চলে। একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করে নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসার ফৌজিয়া ফেরদৌস বলেন, একসময় খেজুরের গাছের সংখ্যা বেশি ছিল এবং গুড়ও উৎপাদন হতো বেশি। আর খেজুরের গুড়ের চাহিদা সব সময় বেশি থাকে। কেন না, এই গুড়ের স্বাদ একটু ভিন্ন ও মজাদার। পিঠাণ্ডপায়েস থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই খেজুরের গুড়ের ব্যবহার বেশি হয়। এছাড়া খেজুরের রস দিয়ে সকালে মুড়ি খাওয়া, রস জ্বাল দিয়ে ভাপা পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। এজন্য খেজুরের রস ও গুড় আমাদের একটা ঐতিহ্যও বটে। কিন্তু কালের বিবর্তনে গাছের সংখ্যা অনেকটা কমে গেছে। তবে কৃষি বিভাগ থেকে খেজুরগাছ লাগানো ও পরিচর্যা করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বাঙালির এই ঐতিহ্য ধরে রাখাসহ অর্থনৈতিক সম্ভার ফিরিয়ে আনতে সবাইকে খেজুরগাছ লাগানোর প্রতি নজর দেওয়া উচিত। সেই বিবেচনায় কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের পাশাপাশি এই বিষয়টির প্রতি কৃষি বিভাগ থেকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, খেজুরের রস ও গুড় দুটোই মানুষের কাছে খুব প্রিয় খাবার। খেজুরের রস ও গুড়কে ঘিরে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে জেলার মানুষ খেজুরের রস দিয়ে গুড় উৎপাদন করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। তবে নিরাপদ গুড় উৎপাদন, সঠিকভাবে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে এ খাত লাভজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। এজন্য ভোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে, খেজুরের রস সংগ্রহ ও গুড় উৎপাদনে গাছিদের সঠিক ধারণা দিতে হবে। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে কৃষি বিভাগ সজাগ আছে এবং খেজুরগাছ রোপণে মানুষকে উৎসাহিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হবে।