টানেল ঘিরে স্বপ্নের হাতছানি

চালকরা মানছে না নিয়মকানুন বাড়ছে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কাও

প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তামীম রহমান, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাইলফলক হিসেবে এরই মধ্যে পরিচিতি পেয়েছে। প্রতিদিন বাড়ছে টোল আদায়। আর এই টানেল ঘিরে নতুন নতুন শিল্প উদ্যোগের খবর এখন নিয়মিতই প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু টানেলে কয়েকটি দুর্ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে নিরাপত্তা তদারকি নিয়ে। দাবি উঠেছে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই উন্নয়ন স্থাপনার নিরাপত্তা আরো জোরদার করার। তবে প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভবিষ্যতে যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে সর্বোচ্চ নজরদারি করা হচ্ছে। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হবে না। টানেল দেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম। আর তা চট্টগ্রামে হওয়ায় দেশের অন্য এলাকার মানুষের পাশাপাশি চট্টগ্রামবাসী বেশি উচ্ছ্বসিত। সেতু-কালভার্ট ও সড়কের সঙ্গে এদেশের মানুষ আগে থেকেই পরিচিত। টানেলের সঙ্গে যোগাযোগটা এবারই প্রথম। ফলে টানেলের ভেতর গাড়ি চালানোর জন্য সব ধরনের নিয়মনীতি আগেই নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে টানেলে চলাচলকারী যানবাহনের গতিসীমা নিয়ে। নির্দিষ্ট গতিসীমা বেঁধে দেওয়া হলেও তা মানছেন না অনেক চালক।

এরই মধ্যে প্রতিযোগিতা করে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর সমালোচনা শুরু হয়। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে গত এক সপ্তাহে তিনটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। সর্বশেষ গত ৩ নভেম্বর রাত ৯টার দিকে প্রাইভেট কারকে পেছন থেকে একটি বাস ধাক্কা দিলে দুর্ঘটনা ঘটে। এতে প্রাইভেট কারের পেছনের অংশ দুমড়েমুচড়ে যায়। এ সময় প্রাইভেট কারের চার যাত্রী আহত হন। টানেলের আনোয়ারা প্রান্ত থেকে টানেলের ভেতরে প্রবেশ করার পর একটি প্রাইভেট কারকে পেছন থেকে বাস ধাক্কা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে টানেলের নিরাপত্তাকর্মীরা গাড়ি দুটি জব্দ করেন। এর আগে আরো দুটি দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে টানেলের ভেতর।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, টানেলের ভেতরে পরিবহণের শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখভাল করছে টানেল কর্তৃপক্ষ। এতে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না সিএমপির ট্রাফিক পুলিশ। পুলিশের গাড়ি টানেলের ভেতর প্রবেশ করলে টোল দিতে হয়। ফলে সেখানে গিয়ে পরিবহণের শৃঙ্খলা দেখভালে আগ্রহ কম পুলিশের। টানেলের নিরাপত্তাকর্মীরা বলেছেন, গত ২৯ অক্টোবর সকাল ৬টা থেকে যানবাহন চলাচলের জন্য টানেল উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ওই দিন স্বাভাবিকভাবে যান চলাচল করেছিল। কিন্তু প্রথম দিন রাতে প্রতিযোগিতা করে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, এরপর টানেলের ভেতর গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলা, নির্ধারিত গতিতে গাড়ি না চালিয়ে কম-বেশি গতিতে চালানোর কারণে ঘটেছে দুর্ঘটনা। নিয়মকানুন মানছেন না চালকরা।

গত ২৯ অক্টোবর মধ্যরাতে টানেলের ভেতর কার রেসিং প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিল কয়েকজন যুবক। দামি কার নিয়ে প্রতিযোগিতায় মেতেছিল তারা। প্রতিযোগিতা করে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর এ নিয়ে সমালোচনা হয়। ওই প্রতিযোগিতায় সাতটি প্রাইভেট কার অংশ নেয়। এ ঘটনায় ১ নভেম্বর রাতে নগরীর কর্ণফুলী থানায় মামলা করা হয়। সড়ক পরিবহণ আইনে মামলাটি দায়ের করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল কর্তৃপক্ষের সহকারী ম্যানেজার মো. জাহাঙ্গীর আলম। মামলার এজাহারে প্রাইভেট কারগুলোর নম্বর উল্লেখ করে চালকদের আসামি করা হয়।

মামলার এজাহারে বলা হয়, টানেল কর্তৃপক্ষ ও রক্ষণাবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক্রমে মোটরযানের গতিসীমা সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হয়। টানেলের প্রবেশমুখ, ভেতরসহ বিভিন্ন দৃশ্যমান স্থানে গতিসীমা সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। ২৯ অক্টোবর রাত ১১টায় ক্রসিং এলাকায় সাতটি প্রাইভেট কার নিয়ে প্রতিযোগিতা করে অজ্ঞাত চালক এবং তাদের সহযোগীরা সর্বোচ্চ গতিসীমা লঙ্ঘন করেছে। গাড়িগুলো ওভারটেকিং ও বিপজ্জনকভাবে চালানোসহ যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। পরে টানেলের সিসিটিভি মনিটরিং কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থলে থাকা সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে সাতটি গাড়ির নম্বর শনাক্ত করে।

সিএমপির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, টানেল দিয়ে পুলিশের গাড়ি প্রবেশ করলে টোল দিতে হচ্ছে। এ কারণে পুলিশ কোনো কারণ ছাড়া টানেলে প্রবেশ করছে না। তবে টানেলের দুই পাশে পরিবহণের শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে ট্রাফিক পুলিশ। বঙ্গবন্ধু টানেল চালুর পর থেকে নিজস্ব সিকিউরিটি ফোর্স এটির নিয়ন্ত্রণ করছে। এখানে কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে প্রাইভেট কার নিয়ে রেসিংয়ের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। আমরা মামলার তদন্ত করে জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা করছি।

শুক্রবার রাতে একটি প্রাইভেট কার দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এ ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি। মামলা হলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

কিছু বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনাকে চট্টগ্রামের সচেন মহল খুব বড় করে দেখতে নারাজ। তারা বলেন, টানেল নতুন এক যোগাযোগ পদ্ধতি। নতুন সিস্টেম। তাই শুরুর দিকে হয়তো কিছু সমস্যা হবেই। পরে এ ধরনের কোনো সমস্যা আর থাকবে না। টানেল নিরাপত্তা দেখার দায়িত্বশীলরা তদারকিতে আরো পেশাদার হয়ে উঠবেন।

শুরুতে টানেল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা। পরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১০ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৪২ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ সুদে ৫ হাজার ৯১৩ দশমিক ১৯ কোটি টাকা দিচ্ছে। বাকি টাকা দেয় বাংলাদেশ সরকার। সেই স্বপ্নের টানেল এখন বাস্তব।