টানেল-ট্রেন চলাচলে বদলে যাচ্ছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের শিল্পায়নের গতি

টানেল এলাকায় বেড়েছে জমির দলিল রেজিস্ট্রি

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তামীম রহমান, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে টানেলের পর চালু হলো ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল পথ। আর এই দুই মহা কর্মযজ্ঞ বাস্তব রূপ লাভ করায় চট্টগ্রামের পাশাপাশি পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। রেলপথে যাত্রীর পাশাপাশি বহন শুরু হবে পণ্য পরিবহণ। এতে চট্টগ্রামসহ পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের ব্যবসা বাণিজ্যের গতি পাল্টে যাবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। ট্রেন চলাচল আনুষ্ঠানিক চালুর মাধ্যমে তা স্থায়ী রূপ লাভ করল। পরিবহণ ট্রেনে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার থেকে খুব কম খরচে সহজে পণ্য বহন করা যাবে ঢাকা পর্যন্ত। এতে কৃষিপণ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্প পণ্যের উৎপাদনও বাড়বে। ট্রেন লাইনের আশপাশে গড়ে উঠবে নানা ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান। উৎপাদিত পণ্যগুলো দ্রুত পরিবহণ করা যাবে মালবাহী ট্রেনে। কম খরচে পরিবহণের মাধ্যমে শিল্প উদ্যোক্তা কিংবা কৃষকরা ভালো লাভ করতে পারবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের আনোয়ারা উপজেলার অংশে দ্রুত বাড়ছে জমির দাম। যেন জমি কেনার হিড়িক পড়েছে। প্রতি মাসে গড়ে ৪০০ জমির রেজিস্ট্রি করছে উপজেলার সাব রেজিস্ট্রার অফিস। অন্তত আগের মূল্যের চেয়ে জমির দাম ৫ থেকে ৬ গুন বেড়েছে। মূলত নতুন শিল্প উদ্যোক্তারা এসব জমি কিনছেন। জমি কেনার মাধ্যমে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার তৎপরতাও দৃশ্যমান হচ্ছে। এতে দক্ষিণ চট্টগ্রামে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি নতুন নতুন শিল্প কারখানার মাধ্যমে রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এতে স্বপ্নের ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ এখন দ্রুতই দৃশ্যমান হবে বলে মনে করছেন নগরবাসী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নানা শ্রেণির শিল্প উদ্যোক্তাদের এখন সরব উপস্থিতি আনোয়ারা এলাকায়। এর মধ্যে জমি কিনে অর্ধশত শিল্প কারখানা চালুর বিষয়ে প্রকল্প পরিকল্পনা শুরুও করা হয়েছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের আগে প্রাক সমীক্ষার কাজ চলছে জোরেশোরে। অনেক কারখানা চালুর প্রায় সব কাজ শেষ করা হয়েছে। সহসা কিছু কারখানা চালুও হতে পারে। টানেলের মাধ্যমে বিমানবন্দরের সাথে দূরত্ব কমে আসায় বিদেশি বায়ারদের কাছ থেকে ভালো সাড়া মিলছে। টানেলের মাধ্যমে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ পরিকল্পনায় মীরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিশাল অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার যে পরিকল্পনা তাতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলছে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরের আনোয়ারা-কর্ণফুলীতে। প্রায় এক একর জায়গাজুড়ে টানেল সংযোগ সড়কের মোড়ে চালুর অপেক্ষায় আছে বিশাল পোশাক কারখানা এইচএস কম্পোজিড টেক্সটাইল। এই পোশাক কারখানায় কর্মসংস্থান হবে প্রায় ৩ হাজার মানুষের। এর আধা কিলোমিটার দূরে সাদ মুসা শিল্পপার্ক রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল (ইপিজেড) হিসেবে কাজ শুরুর চেষ্টায় আছে। বর্তমানে এখানে আটটি শিল্প কারখানা রয়েছে। ইকোনমিক জোন হিসেবে গড়ে তুলতে ৫০০ একর জমি কিনেছেন তারা। নদীর দক্ষিণ তীরে মোস্তাফা হাকিম গ্রুপ দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চালু করেছে ইস্পাত ও অক্সিজেন কারখানা। এইচএম স্টিল ও এইচএম অক্সিজেন প্ল্যান্ট নামের এই দুই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন প্রায় ২ হাজার শ্রমিক। আরো কয়েকটি রি-রোলিং মিল স্থাপনের কাজও এগিয়ে চলেছে।

টানেলের কারণে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড)। টানেল চালুর পর ১০০ একর জমিতে তাদের হাইটেক পার্ক নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এই পার্কে ২০তলার ১৮টি ভবন হবে। এছাড়া দুইটি আলাদা প্রশাসনিক ভবনের কাজ শেষ হয়েছে। উদ্যোক্তাদের আশা সফটওয়্যার, শিল্পোন্নয়ন, ডাটা এন্ট্রি ও আউটসোর্সিং খাতে এখানে ৩০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। পাশাপাশি একটি ফ্যাশন ডিজাইন কমপ্লেক্স গড়ে তোলার কাজও এগিয়ে চলছে।

কেইপিজেডের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, টানেল শিল্প উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই টানেল দুটি প্রান্তকে যুক্ত করে শিল্পায়নের বৃহৎ সম্ভাবনা তৈরি করেছে। শিল্প কারখানা হওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বিদেশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করাটাও দরকার। আগে বিমানবন্দর থেকে বায়াররা কেইপিজেডে আসতে ২ ঘণ্টার বেশি লাগত। এখন তারা টানেল হয়ে ১০ মিনিটে চলে আসছে, যা আরো বেশি অর্ডার আসার ক্ষেত্রে পজেটিভ ভূমিকা রাখবে।

স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এস আলম গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, ফোর এইচ গ্রুপ, ডায়মন্ড সিমেন্ট, পারটেক্স গ্রুপসহ অন্তত ৫০টি শিল্পগ্রুপ এখানে শিল্প কারখানা করার জন্য জমি কিনেছে। আগে থেকে কর্ণফুলীতে চালু আছে সুপার ফার্মাসিক্যাল লিমিটেড, পার্টেক্স পেট্রো লিমিটেড, একর্ন ইনফ্রাস্টাকচার সার্ভিস লিমিটেড, বিএন লুব্রিকেন্ট, বেলামি টেক্সটাইল, এটিপি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, জিএসএল এক্সপোর্ট, বেঞ্চমার্ক অ্যাপারেল, ইউসা ব্যাটারি ফ্যাক্টরিসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। আনোয়ারার সাব রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তারা জানান, জমির দাম বেড়েছে। কেনার হারও বেড়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকে এখানে জমি বেচাকেনা বেড়ে যায়। প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ জমির দলিল রেজিস্ট্রি হচ্ছে। এই হার আরো বাড়বে।

তবে শিল্পোদ্যোক্তারা অনেকে গ্যাস বিদ্যুৎ নিয়ে ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে বলে মনে করছেন। তারা বলেছেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ শিল্পায়নের প্রাণ। যত দ্রুত গ্যাস-বিদ্যুতসহ অবকাঠামো গড়ে তোলা যাবে, শিল্পায়ন ততই দ্রুত হবে।

স্থানীয় একজন শিল্পপতি বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেল মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের সড়কপথে যোগাযোগ সহজ করবে। শুধু আনোয়ারা বা কর্ণফুলীই নয়, মীরসরাই থেকে নদীর পাড় ধরে কক্সবাজার পর্যন্ত বিনিয়োগের বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হবে। পরিপূর্ণ সুফল পেতে কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে করতে হবে পরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন। পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম আট লেইন মহাসড়ক, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। শিল্পায়ন যাতে দ্রুত হয় সেভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোগত সুবিধাও নিশ্চিত করতে হবে। টানেল সংযোগ সড়কের কাছেই রয়েছে প্রস্তাবিত চায়না ইকোনমিক জোনের অবস্থান। ৭৮৪ একর জমিতে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পের গতি বেশ কিছুদিন শ্লথ থাকলেও সম্প্রতি অবকাঠামো নির্মাণে চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ কর্পোরেশন (সিআরবিসি) নামের প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এখানে ওষুধ, তৈরি পোশাক, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, রাসায়নিক, স্বাস্থ্য সরঞ্জাম, প্লাস্টিক পণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, ফার্নেস ও সিমেন্ট কারখানাসহ ৩৭১টি শিল্পকারখানা হওয়ার কথা রয়েছে।