মজুরি বোর্ড ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা প্রত্যাখ্যান করে আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকদের বিক্ষোভ ও ভাঙচুরের ঘটনায় শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় শতাধিক পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এর সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে জানা গেছে।
গতকাল শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার নরসিংহপুর, ইউনিক, শিমুলতলা, জামগড়া, ছয়তলা, নিশ্চিন্তপুর, কাঠগড়া, আমতলা, বড় রাঙ্গামাটিয়াসহ বিভিন্ন কারখানা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ পোশাক কারখানার মূল ফটকে বন্ধের নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। শারমিন গ্রুপের ইশায়াত এ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার গেটে টানানো নোটিশে বলা হয়েছে- ‘গত ৩০ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ৯ অক্টোবর ২০২৩ পর্যন্ত এই কারখানার শ্রমিকগণ বে-আইনিভাবে কাজ বন্ধ রেখে সকাল বেলা হাজিরা দিয়ে বের হয়ে চলে যায়, এছাড়া শ্রমিকগণ কারখানার অভ্যন্তরে এবং বাহিরে ব্যাপক ভাঙচুর, মারামারি, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যাতে কোম্পানির সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি ও আর্থিক ক্ষতিসাধনও হয়। যদিও জাতীয় উন্নয়ন ও ফ্যাক্টরির উৎপাদনের স্বার্থে অনূকূল পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য দুই দিন স্ব-বেতনে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। তথাপিও তারা ফ্যাক্টরিতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মারামারি ও ভাঙচুর অব্যাহত রাখে। পরবর্তীতে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কলকারখানা অধিদপ্তর, বিজিএমইএ এবং কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের বারবার কারখানায় কাজে যোগদান করার অনুরোধ করা সত্ত্বেও শ্রমিকগণ কাজে যোগদান করে নাই, বরং বে-আইনি ধর্মঘট চালিয়ে যায়; যা বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ মোতাবেক অবৈধ ধর্মঘটের সামিল। এমতাবস্থায়, বে-আইনি ধর্মঘটের কারণে কোনোক্রমেই প্রতিষ্ঠনা পরিচালনা করা সম্ভব নয় বিধায়, বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ১৩ (১) ধারা মোতাবেক অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হলো, যা ১১/১১/২০২৩ থেকে কার্যকর হবে এবং এটি সকলের জন্য প্রযোজ্য।’
ডুকাটি অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার গেটে টানানো নোটিশে বলা হয়- গত ৮ নভেম্বর কারখানায় বহিরাগত হামলা হওয়ার কারণে বিকাল ৩টার দিকে কারখানা সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। তবে পরদিন ৯ অক্টোবর শ্রমিকরা কারখানায় প্রবেশ করে কাজ বন্ধ রাখেন। কারখানার কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে বেলা ১১টার দিকে কারখানা ছুটি ঘোষণা করেন। কিন্তু শ্রমিকরা কারখানা ত্যাগ না করে অবৈধভাবে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করতে থাকেন। এতে করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং কারখানার অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলা চরম অবনতি ঘটে। কর্তৃপক্ষ বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও শ্রমিকরা শান্ত না হয়ে চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। শ্রমিকদের এমন আচরণ শ্রম আইন অনুযায়ী অবৈধ ধর্মঘটের আওতায় পড়ে। এমতাবস্থায় কারখানা কর্তৃৃপক্ষ বাধ্য হয়ে নিরাপত্তাহীনতা ও অবৈধ ধর্মঘট করার কারণে ৯ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ শ্রমআইন ২০০৬ সালের ১৩ (১) ধারা অনুযায়ী অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কিংবা কারখানা খোলার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলে তা নোটিশের মাধ্যমে জানানো হবে।’
আগামী এ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার নোটিশে বলা হয়- ‘গত ৩১ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত শ্রমিকরা কারখানায় এসে ফেইস পাঞ্চ করে। তারা কোনো প্রকার আলোচনা ছাড়াই উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রেখে চিৎকার চেঁচামেচি করে। পরে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পর কারখানা ত্যাগ করে বাহিরে চলে যায়। এতে করে নিরূপায় হয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেন। কিন্তু বেতনের আগ পর্যন্ত ৫ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত শ্রমিকরা কাজ চালিয়ে যায়। বেতন হয়ে গেলে ৮ নভেম্বর আবারও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি করে শ্রমিকরা। সাধারণ শ্রমিকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে মিছিল করতে করতে কারখানা গেইটে চলে যায়। এমতাবস্থায় আবারও কর্তৃপক্ষ কারখানা ছুটি দিতে বাধ্য হয়। তাই কারখানা কর্তৃপক্ষ কারখানার সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে ৯ নভেম্বর কারখানা বন্ধ রাখে। এমন কার্যকলাপ বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ মোতাবেক প্রতিষ্ঠানে উচ্ছৃঙ্খলতা ও বে-আইনি ধর্মঘটের শামিল। তাই কারখানা কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে ১১ নভেম্বর হইতে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ১৩(১) ধারা মোতাবেক অনির্দিষ্ট কালের জন্য কারখানা বন্ধ ঘোষণা করিল।’
কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হওয়ার বিষয়টি শ্রমিকদের মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েও জানিয়ে দিচ্ছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
এদিকে শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম জানান, শ্রমিক আন্দোলনের মুখে প্রায় শতাধিক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের কারখানা কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোন চিঠি দেয়নি। তবে বিভিন্নভাবে আমরা বন্ধের খবর পেয়েছি। এছাড়া যেকোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় অন্যান্য দিনের মতো পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে।
শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে অসন্তোষে ১২৩ কারখানা ভাঙচুর হয়েছে। এসব ঘটনায় ২২ মামলায় ৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল শিল্প পুলিশের ডিআইজি মো. জাকির হোসেন খান গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান। তিনি জানান, শ্রমিকদের আন্দোলন কোনাবাড়ীতে বেশি। আশুলিয়াতে কিছুটা আছে বা চট্টগ্রাম এলাকায় আন্দোলন নেই। কোনাবাড়ীতে একটি গ্রুপ এখানে মদত দিচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ ও ইন্টিলিজেন্স সেল আছে তারাও কাজ করছে।
তিনি বলেন, শিল্প পুলিশ, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ, র্যাব, জেলা পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছেন। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সরকার এরই মধ্যে মজুরি ঘোষণা করেছেন। এখানে যারা উসকানি দিচ্ছেন আমরা তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। তিনি আরো বলেন, সাধারণ শ্রমিকদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যারা এ ধ্বংসাত্মক কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত যেসব শ্রমিক ও ওই শ্রমিকদের সঙ্গে বহিরাগত লোক আছে। যেসব শ্রমিকরা এসব ধ্বংসাত্মক কাজের সঙ্গে যুক্ত আছে তারাই আতঙ্কগ্রস্ত হবে তাদের আমরা গ্রেপ্তার করব। এর পেছনে যারা বহিরাগত আছে তাদেরও আমরা গ্রেপ্তার করব। সাধারণ শ্রমিকদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।