কাল ৫৮ বছরে পদার্পণ করছে চবি
সমাবর্তন যেন আকাশের চাঁদ
প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
চট্টগ্রাম ব্যুরো ও চবি সংবাদদাতা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সমাবর্তন যেন আকাশের চাঁদ। ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরিচালিত দেশের চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৫৭ বছরে ইতিহাসে সমাবর্তন হয়েছে মাত্র ৪টি। এদিকে আগামীকাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ৫৮ বছরে পদার্পণ করছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ২৮ বছর পর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলামের দায়িত্বকালীন সময়ে ১৯৯৪ সালে সর্বপ্রথম সমাবর্তন হয় এরপর ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয়, ২০০৮ সালের তৃতীয় এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে ৩১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ সমাবর্তন। এই সমাবর্তনটি আয়োজন করেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। এরপরে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার ২০১৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পরে বিভিন্ন সময়ে ৬ বার সমাবর্তনের ঘোষণা দিলে ও তা কোনোভাবেই বাস্তবায়ন করতে পারেননি। সর্বশেষ তিনি চলতি বছরে শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব হল উদ্বোধনের সময় ৬ষ্ঠ বারের মতো সমাবর্তনের ঘোষণা দেন। এছাড়া একই বছরের ১ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক সমিতির সঙ্গে মতবিনিময় কালে সমাবর্তনের ঘোষণা দেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। পরিসংখ্যান বলছে, ৭৩-এর অধ্যাদেশে পরিচালিত অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে প্রায় ২ বছরে ১ বার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে প্রায় ৬ বছরে ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১০ বছরে একবার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। এ হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ১৪ বছরে একবার সমাবর্তন হচ্ছে।
চবিতে সর্বশেষ এবং সর্ববৃহৎ সমাবর্তন হয়েছিল ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি প্রায় ৭ বছর আগে। এতে ২০০৪ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর এবং ২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পিএইচডি-এমফিলসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা অংশ নেয়। মোট ৭ হাজার ১৯৪ জন গ্রাজুয়েট। সর্বশেষ সমাবর্তনটি করেছিলেন চবি উপাচার্য প্রফেসর ডক্টর ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী।
দীর্ঘ ৮ বছর ধরে পঞ্চম সমাবর্তনের অপেক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউট থেকে তাদের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি শেষ করেছে। প্রতিবছর সমাবর্তনের জন্য বাজেট থাকার পরেও সমাবর্তন আয়োজনের ব্যর্থতায় হতাশা প্রকাশ করেছে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী।
পঞ্চম সমাবর্তনের লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো চবির বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ডক্টর শিরীন আখতার সমাবর্তনের ঘোষণা দেন ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায়। একই বছর ১৬ নভেম্বর চবির ৫৬তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দ্বিতীয়বারের মতো ঘোষণা দেন। এরপর ২০২২ সালের ২৩ জুলাই ৩৪তম সিলেট সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে তৃতীয়বারের মতো আবারো পঞ্চম সমাবর্তন আয়োজনের ঘোষণা দেন। সেই বছরই ১৭ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ৫৭ দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে চতুর্থবারের মতো পঞ্চম সমাবর্তন আয়োজনের ঘোষণা দেন।
পরপর ছয়বার সমাবর্তনের ঘোষণা দেয়ার পরেও চূড়ান্ত কোনো তারিখ বেঁধে দিতে পারেনি। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী এবং সিনিয়র শিক্ষকরা ভিসির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, সমাবর্তন আয়োজনে শান্তিপূর্র্ণ পরিবেশ প্রয়োজন। কিন্তু প্রায় প্রতিবারই কোনো না কোনো ধরনের অস্থিরতা দেখা যায়, তা শিক্ষার্থী, শিক্ষক বা অন্যান্য কর্মচারীদের মধ্যেই হোক না কেন।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আরো দাবি করেছে, বিভিন্ন ব্যাচে সেশন জ্যামের কারণে অনেক শিক্ষার্থী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের স্নাতক শেষ করতে পারছে না। সেশন জ্যামের সম্মুখীন শিক্ষার্থীদের জন্য বার্ষিক সমাবর্তন আয়োজন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সমাবর্তনের জন্য বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ করলেও সেই অর্থ অন্য খাতে ব্যয় হয়। তবে এবারের বাজেট অধিবেশনে সমাবর্তন খাতে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে, ইতিহাস বিভাগের একজন স্নাতকোত্তর-ডিগ্রি শিক্ষার্থী বলেন, ‘অনিয়মিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানের কারণে, অনুষদ সদস্যদের মধ্যে একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসরণে উদাসীনতা রয়েছে। ফলে অধিকাংশ বিভাগে শিক্ষকরা সময়মতো ক্লাস নেন না। সেশন গ্যাপ বাড়ছে। নিয়মিত সমাবর্তন হলে শিক্ষকরা আরো দায়িত্বশীল হবেন।
দর্শন বিভাগের মহসিন হোসেন বলেন, ‘প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব এবং রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতাই অনিয়মিত সমাবর্তনের কারণ। তবে প্রশাসনের একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা থাকা উচিত।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজুদ্দৌলা চৌধুরী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘যেহেতু সমাবর্তন হওয়ার একটা রেওয়াজ রয়েছে তাই সমাবর্তন সময়মত হওয়া উচিত কারণ সমাবর্তন ছাড়াও আমাদের শিক্ষার্থীরা ছবি সার্টিফিকেট নিয়ে চাকরি-বাকরি করছে। তারপরও শিক্ষার্থীদের একটা স্বপ্ন থাকে সমাবর্তনে যোগ দেয়ার তাই এটা সময়মতো হওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যেই আসুক তার এদিকে একটু আন্তরিক হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি।’
অন্যদিকে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি বলব যে সমাবর্তন রেগুলারলি হওয়া উচিত। এটা একটা রুটিন কাজ; কিন্তু বিভিন্ন কারণে হয় না। এর জন্য প্রশাসনিক উদ্যোগের দরকার এটাই আমি মনে করব। আমি শুনছিলাম মাঝখানে সমাবর্তন হবে এখন কি কারনে পিছিয়েছে তা তো আমাদের জানা না। এবং আমারা জানি না। তবে আমার বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে শুনেছি সমাবর্তন হবে এবং সময়টিও সম্ভবত বলেছিল; কিন্তু কেন হল না আমরা তো আর জানি না। আমরা তো চাই যে সমাবর্তন হোক। কি কারণে আবার ডেট নির্ধারণ করেনি তা তো আমরা জানি না।’
সমাবর্তন নিয়ে আলোচনার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের সঙ্গে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।