চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্ববৃহৎ ক্যাম্পাসের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা ও প্রাকৃতিক ঝরনা বেষ্টিত এক মনোরম সুন্দর ক্যাম্পাস। এখানে প্রকৃতি যেন নিজ সাজে সেজেছে। বিশ্বের একমাত্র শাটল ট্রেনভিত্তিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ক্যাম্পাসে হরহামেশাই দেখা মিলে বিশাল আকৃতির অজগর সাপ। যা ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যকে কয়েকগুন বাড়িয়ে দেয়। প্রাকৃতিক সৌর্ন্দের লীলাভূমি পাহাড়ি সৌন্দর্যের আধার সবুজ উদ্ভিদের বুক চিরে নির্মিত ২৩০০ একরের আজ ৫৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর যাত্রা শুরুর পর আজ ৫৮ বছর পূর্ণ হবে। এটি দেশের তৃতীয় এবং শিক্ষাঙ্গন আয়তনের দিক থেকে দেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার উত্তরে হাটহাজারী থানার ফতেহপুর ইউনিয়নের ১ হাজার ৭৫৩ একর পাহাড়ি এবং সমতল ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির আয়তন প্রায় ২৩০০ একর। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর ২০০ জন শিক্ষার্থী সাতজন শিক্ষক এবং বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি ও ইতিহাস এই চারটি বিভাগ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের সর্ববৃহৎ এ বিশ্ববিদ্যালয়টি তার কার্যক্রম শুরু করে।
বর্তমানে ৯টি অনুষদ, ৫৪টি বিভাগ, ৬টি ইনস্টিটিউট, ৫টি গবেষণা কেন্দ্র, ৯২০ জন শিক্ষক এবং ২৮ হাজার শিক্ষার্থীকে নিয়ে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম চলছে এখানে। বিশ্ববিদ্যালয় ১৪টি আবাসিক হল রয়েছে এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মকর্তা- কর্মচারীদের জন্য আবাসিক ভবন রয়েছে।
বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণ ও অধ্যাপনা করেছে যার মধ্যে একজন নোবেল বিজয়ী এবং একাধিক একুশে পদক বিজয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার জন্য হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, এমআইটি, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়, স্ট্যানফোর্ড, ক্যামব্রিজ, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিংস কলেজ লন্ডনে লেখাপড়া করছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র এখন গুগল, ফেসবুক, মাইক্রোসফট, টেসলা এবং ফোর্ডসহ শীর্ষ কর্পোরেট, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিতে কাজ করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটি দেশের সবচেয়ে বড় বই সমৃদ্ধশালী গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে একটি। এখানে রয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার বই, অডিও-ভিজুয়াল উপাদান, পাণ্ডুলিপি এবং অন্ধদের জন্য ব্রেইল। রয়েছে ৩ হাজার ৫০০ বিভিন্ন ধরনের পত্রপত্রিকা এবং ইন্টারনেট সুবিধা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকে শাটল ট্রেনের বিশ্ববিদ্যালয়ও বলে থাকেন। শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় ১৯৮০ সালে চালু হয় শাটল ট্রেনটি। এই শাটল ট্রেনটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের একমাত্র বাহন। প্রতিদিন হাজার হাজার শিক্ষার্থী এতে যাওয়া আসা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টি মহান মুক্তিযুদ্ধের মাত্র ৫ বছর আগে চালু হওয়ায় ৬৯ গণঅভ্যুত্থান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের বিভিন্ন আন্দোলনের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, ১২ জন শিক্ষার্থী, ও তিনজন কর্মকর্তা শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলী দপ্তরের কর্মচারী মোহাম্মদ হোসেনকে বীর প্রতীক খেতাব দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ মুখে জিরো পয়েন্ট চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ স্মরণ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে তিনটি জাদুঘর। যে জাদুঘরগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলেছে। ১৯৭৩ সালে মধ্যযুগের চারটটি কামান নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের কার্যক্রম শুরু হয়। জাদুঘর ভবনটি পাঁচটি গ্যালারিতে বিভক্ত। যেখানে রয়েছে : প্রাগৈতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গ্যালারি, ভাস্কর্য গ্যালারি, ইসলামী আর্ট গ্যালারি, লোকশিল্প গ্যালারি এবং সমসায়িক আর্ট গ্যালারি। জাদুঘরটি সকল খোলার দিনে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
আর প্রাণিবিদ্যা জাদুঘরটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের পাঠক্রমের সমর্থনে সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্থাপিত হয়। জাদুঘরে প্রায়ই ৫৪০টি নমুনা সংরক্ষিত রয়েছে।
সর্বশেষ সমুদ্রসম্পদ জাদুঘরটি গড়ে তোলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের একটি কক্ষে। এখানে হাঙ্গর, বৈদ্যুতিক মাছ, অক্টোপাস, শামুক, বিভিন্ন প্রজাতির সাপসহ ৫৫০টির মতো সামুদ্রিকপ্রাণী সংরক্ষণ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে ৫টি স্মৃতিস্তম্ভ ও ভাস্কর্য।
বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে স্থাপন করা হয়। ১৯৮৫ সালে স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভটি এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃজনশীল কর্মের স্মৃতিকাগার হিসেবে ভাবা হয়।
ষাটের দশকে তিনটি স্তম্ভের আদলে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সেটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পরে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভের বিপরীত পাশে বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য রফিকুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৯৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশের পথেই স্থাপন করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ স্মরণ। স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন, শিক্ষক, ১১ জন ছাত্র এবং তিনজন কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সর্বমোট ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ আর বিরত্বের স্মৃতিস্বরূপ ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সামনে স্বাধীনতা স্মৃতি ম্যুরাল ভাস্কর্যটির অবস্থান। খ্যাতিমান শিল্পী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক মর্তুজা বসিরের একক প্রচেষ্টা এটি নির্মিত হয়। ভাস্কর্যটির ৪টি পাখির প্রতীকী নির্মাণে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাঙালির ৬ দফা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্রমধারা এবং পাখির ডানায় ২১টি পাথরের টুকরায় লিপিবদ্ধ হয়েছে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি।
বুদ্ধিজীবী চত্বরে নির্মিত জয় বাংলা ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয় ২০১৮ সালে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই ভাস্কর্যের দুটি স্তরের, উপরের অংশে রয়েছে চামড়া সংযুক্ত তিনজন সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা অবয়ব; যাদের মধ্যে দুজন পুরুষ ও একজন নারী। নিচের অংশে ব্যবহৃত ২০টি মানব অবয়বের মধ্যে রয়েছে দুইজন পাহাড়ি-বাঙালির অবয়ব, যাদের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি ও বাঙালিদের অংশগ্রহণ তুলে ধরা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান, বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ও বন্যপ্রাণী। দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে ফরেস্ট্রি, সেন্ট্রাল ফিল্ড, ঝুলন্ত সেতু, কলা অনুষদের পেছনের ঝর্ণা, প্যাগোডা, টেলিটক হিল, হতাশার মোর, চালন্ত গিরিপথ।
বন্যপ্রাণীগুলোর মধ্যে অন্যতম মায়া হরিণ, সজারু, হরেক রঙের পাখি বিভিন্ন প্রজাতির সাপসহ নানা প্রাণী।
৫৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ৫৮ বছর পার করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের করে গড়ে তুলতে আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাব। আমার সুদক্ষ সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে পথ চলতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দায়িত্ব রাষ্ট্রপতি আমার কাঁধে দিয়েছেন, তা সৎ ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করব। আর এ পথচলায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে একটি পরিবারের মতো এগিয়ে যেতে চাই।’