দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে লেগেছে নির্বাচনি হাওয়া। নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা। মন্ত্রীদের অনেকেই নির্বাচনি এলাকায় গিয়েছেন, অফিস করছেন না। আগামী নির্বাচনি কেমন হবে, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল কীভাবে নির্বাচনে আসবে, ছোট ছোট দল জোট বদ্ধ নির্বাচন করবে নাকি এককভাবে নির্বাচন করবে, তা নিয়েই চলছে সরকারি কর্মকর্তাদের আলাপ-আলোচনা। নির্বাচনকালীন সরকার কেবল রুটিং দায়িত্ব পালন করবে, আর সে কারণে কর্মকর্তাদের মধ্যে দায়িত্ব পালনে ‘হাল ছাড়া’ ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাদের নজর এখন নির্বাচন কমিশনের দিকে। নির্বাচন কমিশন যেসব নির্দেশনা দেবে সেই সব নির্দেশনার আলোকে তারা দায়িত্ব পালন করবেন। এমন ধারণা নিয়েই তারা সরকারি দায়িত্ব পালন করছেন। সচিবালয়ে তদবির পার্টির আনাগোনা এখন আর নেই। তদবির করে কোনো কাজ আদায় করা যাবে, এমন ধারণা এখন আর কেউ পোষণ করছেন না।
সচিবালয়ে এখন নির্বাচনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগে নির্বাচন প্রশ্নে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যে অস্থিরতা ছিল, তফসিলের পর সেটি আর নেই। প্রশাসনের নিম্ন, মধ্যম ও উচ্চস্তরের কর্মকর্তাদের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে। রুটিন মাফিক সরকারি কাজের পাশাপাশি নির্বাচনি নিয়ে কর্মকর্তারা একে-অপরের সঙ্গে আলোচনা করছেন। সচিবালয়ে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ঘুরে দেখা গেছে, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আলোচনা করছেন। তারা বলছেন- আওয়ামী লীগ সরকার এক টানা ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দায়িত্ব থাকায় দেশের অবকাঠামো থেকে শুরু করে ডিজিটালাইজেশনের কাজ বহুদূর এগিয়েছে। সরকারের উন্নয়ন সারা দেশে দৃশ্যমান হয়েছে। চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। সেজন্য সরকারের অর্জন তুলে ধরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মাঠে নামা দরকার। নিজেদের অর্জন প্রচারের জন্য প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলে কনসার্টের আয়োজন করা দরকার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নিজেদের প্রচারণা চালাতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন কয়েকজন যুগ্ম সচিব বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উৎসবমুখর করতে আওয়ামী লীগকে উপযুক্ত প্রার্থী খুঁজে বের করতে হবে। কেন না, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে। যেসব নির্বাচনি এলাকায় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কম বলে মনে করা হয়, সেখানে শক্তিশালী প্রার্থী দিতে হবে। নির্বাচন নিয়ে সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ বিরাজ করছে।
গত কয়েক দিনের কার্য দিবসে সচিবালয়ে ঘুরে দেখা গেছে, নির্বাচন কমিশন তপশিল ঘোষণার পর মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা নিজ নিজ এলাকায় তাদের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ ও নির্বাচনি প্রচারণায় নেমেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সচিবালয়ে যারা কর্মরত আছেন, তাদের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে ‘পদোন্নতি’। আর আওয়ামী লীগ সরকার কর্মকর্তাদের সেই পদোন্নতির জায়গাটি নিশ্চিত করেছে। ফলে চলমান দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে কর্মকর্তাদের ভেতরে স্বস্তি ফিরেছে, একই সঙ্গে নিজেদের কর্মক্ষেত্রের রুটিন কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ কর্মকর্তারা জানেন আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেখানে তপশিল ঘোষণা থেকে নির্বাচন পর্যন্ত দেড় মাস সময়ের ব্যবধান, যা দেখতে দেখতেই চলে যাবে।
সচিবালয়ে কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনি তপশিল ঘোষণার পর মন্ত্রণালয়ে বদলি ও পদোন্নতির ছাড়া সব ধরনের কাজ চলছে। কিছু মন্ত্রী আগের মতোই সচিবালয়ে অফিস করছেন। আবার প্রয়োজনে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং করছেন। নাম প্রকাশ না করা শর্তে একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, মার্কিন ভিসা নীতি প্রয়োগের পর ঝোপ বুঝে কোপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন অনেকে। তবে নির্বাচন কমিশন তপশিল ঘোষণার পর ঝোক বুঝে কোপ দেওয়ার ইস্যুটি বন্ধ হয়েছে। কর্মকর্তারা এখন আর মার্কিন নীতি নিয়ে ভাবছে না। জনগণের উন্নয়নে প্রতিটি মন্ত্রণালয় মাঠপর্যায়ে কর্মকাণ্ডের তদারকি বাড়িয়েছে। যারা নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করবে, তাদের ভিসা প্রত্যাখ্যান করবে যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচনের সঙ্গে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরাসরি যুক্ত নয়, সুতরাং মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে আমাদের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে কেবলমাত্র আওয়ামী লীগ সরকার বিব্রত ছিল এমন নয়, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপরও চাপ তৈরি হয়েছিল। সেই চাপ কেটে গেছে। বাংলাদেশে এই অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনের তপশিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে সহজেই তা অনুমেয়। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের একটা বিশাল অংশ আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে, অন্যদিকে বর্তমান উন্নয়ন কার্যক্রমের সিংহভাগই বাস্তবায়িত হচ্ছে চীনের সহযোগিতায়। মাঝখানে রয়েছে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বন্ধু ভারত। এসব বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে অর্থনৈতিক খাতকে চেপে ধরার চেষ্টা করে সেটিও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ফলপ্রসূ হবে না।
গত বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল আগামী ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ তপশিল ঘোষণা করেন। পরের দিন বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, যেহেতু তপশিল ঘোষণা হয়ে গেছে, সরকার এখন রুটিন কাজ করবে। উন্নয়ন কাজ যেগুলো আছে সেগুলো চলমান থাকবে কিন্তু নতুন করে উন্নয়নকাজ শুরু হবে না; যা কিছু নির্বাচনে একটা দলের পক্ষে প্রভাবিত করতে পারে সে রকম কাজ আমরা করব না। একই দিনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান সচিবালয়ে ঘূর্ণিঝড়ের ‘মিধিলি’ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং করেন। পরে জনসচেতনা বাড়াতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা নিয়মিত সচিবালয়ে আসছেন এবং চলমান উন্নয়ন কাজগুলো নিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করছেন।
জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। সেপ্টেম্বরে ২২১ জন উপসচিব ও সমপদমর্যাদার কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে যুগ্ম সচিব করা হয়েছে। এর আগে গত মে মাসে ১১৪ জন অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। উপসচিব পদে ১৭৮ কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়। এসব পদোন্নতি নির্বাচন সামনে রেখে হয়নি; নিয়মতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় এসব পদোন্নতি হয়েছে। সর্বশেষ ১৪ সেপ্টেম্বর সিনিয়র সহকারী সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন প্রশাসনের ২৭০ কর্মকর্তা। কারণ, কর্মকর্তাদের পদোন্নতির বঞ্ছনার শিকার হয়ে কাজে হতাশা চলে আসে। এছাড়া সরকার মনে করছে কর্মকর্তাদের মনোবেদনা থাকলে বা হতাশা থাকলে তাদের কাজে মনোযোগ থাকে না। সে কারণে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সরকারের অতিরিক্ত সচিব এসএম আলম বলেন, নির্বাচনের তপশিল হওয়ার পরই নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সব দপ্তর নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলে গেছে। এখন নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে শতভাগ সততার সঙ্গে কাজ করি। প্রধানমন্ত্রী, ইসি, জাতিসংঘসহ যুক্তরাষ্ট্রও চায় সুষ্ঠু নির্বাচন। আমরাও চাই সুষ্ঠু নির্বাচন। তাহলে চিন্তার কোনো কারণ দেখি না।
একজন যুগ্ম সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের এখন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। নিষেধাজ্ঞা এসেছে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। এর সমাধানও রাজনৈতিকভাবেই হতে হবে। সুতরাং, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক সমাবেশে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ চলবে সংবিধান অনুযায়ী। কোনো দেশের নিষেধাজ্ঞা মানি না। ’৭১ সালে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আমাদের হারাতে পারেনি, আজও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে শেখ হাসিনাকে থামানো যাবে না। আমরা কারো নিষেধাজ্ঞা পরোয়া করি না।’