মায়ার জাদুতে পর্যটকদের কাছে টানছে পৃথিবীর তৃতীয় পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা। নভেম্বরের মাঝামাঝিতে উত্তরের নীল আকাশে উদয় হয়ে মায়াজাল ছড়িয়ে দেয় এই মায়াবী কাঞ্চনজঙ্ঘা। এমন সৌন্দর্যের মোহনীয় রূপ দেখতে হিমালয়কন্যা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ছুটে যাচ্ছেন পর্যটকরা। অপার সৌন্দর্যের রূপ তৃপ্তি ভরে দেখছেন নানা বয়সি দর্শনার্থীরা। তবে হরতাল-অবরোধে দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকার কারণে কমে গেছে পর্যটকদের সমাগম। তেঁতুলিয়া থেকে হিমালয়ের এই পর্বতশৃঙ্গের দূরত্ব মাত্র ১০০ কিলোমিটার। শত কিলোমিটার দূরে থাকলেও বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ এই পর্বতশৃঙ্গ নিজের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেয় এর আশপাশে। ভোরবেলা সূর্যের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিক থেকে উদয় হয় কাঞ্চনজঙ্ঘার। সূর্যের আলোর ছোঁয়ায় সোনালি রঙে দেখা দেয় এই পর্বতশৃঙ্গ। গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার ভোর থেকে দিনভর পরিষ্কার আকাশে বিমোহিত রূপে দেখা দেয় অপরূপ ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো সংলগ্ন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষে বয়ে যাওয়া মহানন্দা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ উপভোগ করতে পর্যটকরা একে অপরকে হাত নাড়িয়ে বলছেন, আহা কী সুন্দর। কী মোহনীয় রূপের আধার এ পর্বতশৃঙ্গ। দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে যেন নেপালকে অনুভব করছি। আমরা নেপাল থেকে এই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাচ্ছি। যদিও স্থানীয়দের জন্য এর রূপ চিরচেনা। রংপুর থেকে আসা পর্যটক রবিন জানান, এর আগেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে এসেছিলাম। খুব ভোরে তেঁতুলিয়ায় এসেছি। কি বলব, অসাধারণ এক রূপ দেখলাম কাঞ্চনজঙ্ঘার। দেখেও তৃপ্তি মিটছে না। মনে হয় আরো দেখি। এখানেই থেকে যাই। কাঞ্চনজঙ্ঘার এমন মায়াবী জাদুতে এখান থেকে ফেরা কঠিন। প্রতিদিন ভোরে উঠে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেও তৃপ্তি পান বলে জানালেন বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের কাস্টমসের কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, কর্মক্ষেত্রের কারণে আমি বাংলাবান্ধায় শুল্ক স্টেশনে রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এই সময়টাতে প্রতিদিন ভোরে ঘুরতে বেরিয়ে দেখি কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপমাধুর্য। কী যে ভালো লাগে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। এ কাঞ্চনজঙ্ঘা ঘিরে এখানে পর্যটন শিল্পে নতুনমাত্রা তৈরি হয়েছে। তেঁতুলিয়ার সর্বউত্তরের একটি গ্রাম জায়গীরজোত। গ্রামটির পর বাংলাদেশের আর কোনো ভূখন্ড নেই। এই গ্রামের বেড়ে ওঠা মোনালিসার। তিনি বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাছে কপোতাক্ষ নদ যেমন আমাদের কাছে মহানন্দা নদীর তীরে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার অনুভূতি অনেকটা তেমনই। প্রতিবছরই শীতের শুরুতে এর দেখা মেলে। সীমান্তঘেঁষা গ্রাম হওয়ায় খুব কাছ থেকেই এটি আমাদের কাছে ধরা দেয়। যদিও প্রতিদিন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় না। অনেকসময় পর্যটকরা এসে হতাশ হয়ে ফিরে যান। কলেজশিক্ষার্থী ফারহানা সুুধা জানান, আমার বাড়ি তেঁতুলিয়ার ইসলামবাগ এলাকায়। এখান থেকে চা-বাগানে দাঁড়িয়ে এই সময়ে ভোরে প্রতিদিন মুগ্ধ হয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপসৌন্দর্য্য উপভোগ করি। কী যে ভালো লাগে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো। অপলক চেয়ে থেকেও তৃপ্তি মিলে না। হিমালয় পর্বতমালায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা। কাঞ্চনজঙ্ঘার উচ্চতা প্রায় ২৮ হাজার ১৬৯ ফিট বা ৮ হাজার ৫৮৬ মিটার। এটি ভারতের সিকিম রাজ্যের সঙ্গে নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে অবস্থিত। এ এলাকা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার পাহাড়টি কাছে হওয়ায় বিনা পাসপোর্ট-ভিসায় দেশের মাটি থেকে খালি চোখে দেখা মেলে অপরূপ সৌন্দর্যের মায়াবী কাঞ্চনজঙ্ঘা। সূর্যোদয়ের সময় মনে হয় যেন কাঞ্চনজঙ্ঘার সাদা বরফ সোনায় ছেয়ে গেছে। দিনের প্রথম সূর্যকিরণ বরফে এমনভাবে প্রতিফলিত হয় তা দেখতে যেন সোনার পাহাড়। বেলা বাড়লে আবার সেই রূপ বদলায়। দিনের মধ্যভাগে মনে হয় প্রকাণ্ড মেঘ উত্তরের আকাশ দখল করে দাঁড়িয়ে আছে। বিকালের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ যেন লজ্জা রাঙা। আর গোধূলিবেলায় পুরো কাঞ্চনজঙ্ঘা আবির খেলায় মেতে ওঠে। ছবির মতো ভেসে ওঠা শুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য ছাড়াও দেখা মেলে প্রতিবেশী দেশ ভারতের দার্জিলিংয়ের বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চল। স্থানীয়রা জানান, শীত আসার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ অঞ্চলে পর্যটনের মৌসুম। অক্টোবর-নভেম্বরে হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাওয়ায় কাঞ্চনজঙ্ঘা ঘিরে তৈরি হয়েছে পর্যটনের নতুন রসদ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা বয়সি পর্যটকরা ছুটে আসেন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে। ফলে পর্যটকের সমাগম ঘটে থাকে এখানে। পর্যটকরা ডাকবাংলোর পিকনিক কর্নার ও মহানন্দা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে দেখে থাকেন কাঞ্চনজঙ্ঘা। তেঁতুলিয়া ছাড়াও পঞ্চগড়ের বিভিন্ন এলাকা থেকে দেখা যায় এই পর্বত। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও জেলায় রয়েছে নানা দর্শনীয় স্থান। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর, ইমিগ্রেশন ও জিরো পয়েন্ট, ইংরেজ আমলে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, সমতল ভূমির চা-বাগান, আনন্দধারা পার্ক, ভিতরগড় দুর্গনগরী, মহারাজা দিঘি, পাথরের জাদুঘর, মোগল স্থাপনা মির্জাপুর শাহী মসজিদ, বদেশ্বরী পীঠ মন্দিরসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান মুগ্ধতা বাড়ায় পর্যটকদের