অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় চারদিনের যুদ্ধবিরতি কার্যকর বিলম্বিত হয়েছে। গতকাল থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও সেটি বিলম্বিত হবে বলে জানিয়েছে ইসরাইলের একজন কর্মকর্তা। যুদ্ধবিরতি কার্যকর না হলে জিম্মি করা ইসরাইলিদেরও মুক্তি দেওয়া হবে না বলে সাফ জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস।
কাতারের মধ্যস্ততায় বুধবার দীর্ঘ আলোচনার পর ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল ইসরাইল ও হামাস কর্তৃপক্ষ। যা গতকাল থেকে তা কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। এই খবরে একটু স্বস্তির আশায় বুক বেঁধেছিল অসহায় ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলি বন্দিদের পরিবার। তবে বহুল প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি কার্যকরে বিলম্বিত হওয়ার খবর তাদের এ আশায় যেন পানি ঢেলে দিল। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গাজায় শুক্রবারের (আজ) আগে হামলা বন্ধ করবে না তারা। এদিকে, সশস্ত্রগোষ্ঠী হামাসও সাফ জানিয়ে দিয়েছে, যুদ্ধবিরতির আগে ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হবে না। গত বুধবার ইসরাইল সরকার ও হামাস যুদ্ধবিরতির চুক্তির বিষয়ে একমত হয়। সে অনুযায়ী, গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে গাজায় চার দিন ইসরাইলি হামলা বন্ধ রাখার কথা ছিল। এ চুক্তির আওতায় অন্তত ১৫০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার কথা ইসরাইলের। একইসঙ্গে চুক্তিতে গাজায় আরও মানবিক সহায়তা প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হবে বলা হয়। এর বিনিময়ে ইসরাইল থেকে জিম্মি করা অন্তত ৫০ জনকে মুক্তি দেবে হামাস। গাজায় যুদ্ধবিরতি তবে হঠাৎ করেই কেন মত পাল্টাল ইসরাইল তা জানা যায়নি। চুক্তির কিছুক্ষণ পরই ইসরাইলের ওই কর্মকর্তা জানান, শুক্রবারের আগে গাজায় হামলা বন্ধ করবেন না তারা। এর কিছুক্ষণ আগেই দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জাকি হানেগবি জানিয়েছিলেন, শুক্রবারের আগে হামাসের হাতে জিম্মি হওয়া কাউকে মুক্তি দেওয়া হবে না। তবে এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি তিনি। এছাড়া, হানেগবির বক্তব্যের কোনো ব্যাখ্যাও দেননি ইসরাইলি কর্মকর্তারা।
গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে সিরিজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় হামাস। এতে দেশটির ১ হাজার ২০০ জন বেসমারিক নিহত হন। সেদিন ইসরাইলের ২৪০ জনকে জিম্মিও করে হামাস। হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়ায় সেদিনই গাজায় নির্বিচারে বোমা হামরা শুরু করে ইসরাইল বাহিনী। এর পর থেকে অব্যাহত হামলায় গাজার ১৪ হাজারের বেশি বাসিন্দা নিহত হয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
ইসরাইলের মধ্যে বৃহস্পতিবার থেকে চারদিনের যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে এ যুদ্ধবিরতি একদিন পিছিয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ইসরাইলি সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, বৃহস্পতিবার থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু নাও হতে পারে। এমনকি যেসব বন্দি মুক্তি পাবে তাদের নাম যতক্ষণ পর্যন্ত চূড়ান্ত না হচ্ছে- ততক্ষণ যুদ্ধবিরতি হবে না। আর তাই কাতারের মধ্যস্থতায় শুরু হতে যাওয়া যুদ্ধবিরতির বিষয়টি একটি ধাক্কা খেয়েছে বলেও জানিয়েছে আলজাজিরা।
ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম কান জানিয়েছে, ‘বৃহস্পতিবারও যুদ্ধ চলবে’। হারেৎজ নামে ইসরাইলি অপর এক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ‘গাজা উপত্যকায় লড়াই থামবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত হামাসের সঙ্গে চূড়ান্ত সময়সীমা নিয়ে চুক্তি না হচ্ছে।’ তবে ইসরাইলি এসব সংবাদমাধ্যমের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
গাজায় নিহত শিশুর সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৬ হাজার
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর গত দেড় মাসের অভিযানে নিহত শিশুদের সংখ্যা ৬ হাজার এবং নারীদের সংখ্যা ৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। মোট নিহতের সংখ্যা পৌঁছেছে ১৪ হাজার ৫৩২ জনে। এই নিহতদের পাশাপাশি আহত হয়েছেন ৩৫ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। এই আহতদের মধ্যেও নারী ও শিশুদের হার ৭৫ শতাংশের ঊর্ধ্বে। সাধারণ ফিরিস্তিনিরা ছাড়াও গত দেড় মাসে গাজায় নিহত হয়েছেন ২০৫ জন ডাক্তার-নার্স-চিকিৎক, ২৫ জন ফায়ার সার্ভিস কর্মী এবং ৬৪ জন সাংবাদিক। গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এদিকে পৃথক এক বিবৃতিতে গাজার প্রশাসনিক কার্যালয় জানিয়েছে, ইসরাইলি বিমান বাহিনীর গত দেড় মাসের গোলা বর্ষণে উপত্যকার ৪৫টি বাসভবন ১০২টি সরকারি ভবন, ২৬৬টি স্কুল এবং ৮৫টি মসজিদ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার বাসভবন, ১৭৪টি মসজিদ এবং ৩টি গির্জা।
এছাড়া গাজার ২৬টি হাসপাতাল এবং ৫৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র আর স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছে প্রশাসনিক কার্যালয়। গত ৭ অক্টোবর ভোরে ইসরাইলে অতর্কিত হামলা চালায় গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধারা। উপত্যকার উত্তরাঞ্চলীয় ইরেজ সীমান্ত বেড়া ভেঙে ইসরাইলে প্রবেশ করে নির্বিচারে সামরিক-বেসামরিক লোকজনকে হত্যা করে তারা। সেই সঙ্গে জিম্মি হিসেবে গাজায় ধরে নিয়ে যায় ২৪২ জনকে।
ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, এই জিম্মিদের মধ্যে ইসরাইলিদের সংখ্যা ১০৪ জন। বাকি ১৩৮ জনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা, রাশিয়া ও ইউক্রেনের নাগরিকরা রয়েছেন। হামাসের এই হামলার জবাবে ৭ অক্টোবর থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরাইলি বিমান বাহিনী। ১৬ অক্টোবর থেকে সেই অভিযানে যোগ দেয় স্থল বাহিনীও।
সূত্র: বিবিসি ও আল-জাজিরা।